৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২২২টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই দলটি বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করলো।
১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের পর সকলের দৃষ্টি ছিল মন্ত্রী পরিষদে কারা স্থান পাচ্ছেন, সেদিকে। এবারের মন্ত্রিসভা গঠিত হলো ২৫জন পূর্ণমন্ত্রী আর ১১জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে। দুজন টেকনোক্র্যাট-সহ সাইত্রিশজন সদস্যের মধ্যে নতুন মুখের আগমন যেমন ঘটেছে, তেমনি পুরোনো অনেকের স্থান হয়নি।
আবার কারো পরিবর্তন হয়েছে মন্ত্রণালয়। এদিকে নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী করণীয় নিয়ে দেশী ও আন্তর্জাতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত, চীন ও রাশিয়াসহ মোট ১৯টি দেশ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চতুর্থবারের মত বিজয়ী হওয়ায় অভিনন্দন জানান। নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু ও অবাধ থাকলেও বড় একটি রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি দলের নির্বাচনে অংশ না নেয়াকে গণতন্ত্রের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে অস্ট্রেলিয়া।
তবে বাংলাদেশকে একটি উন্মুক্ত, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের বিষয়ে দেশটির প্রতিশ্রুতির কথাও জানা যায়। এর পাশাপাশি নতুন সরকারের কাছে “গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে” আহ্বান জানান।
জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সরকারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের উপর জোর দেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে “অবাধ ও সুষ্ঠু মানদণ্ডের মাত্রা অনুসৃত হয়নি” বলে মন্তব্য করলেও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সাথে অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন, মানবাধিকার ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানান।
নতুন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য অর্জনে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, কোনো সমস্যা সমাধানকে অগ্রাধিকার দিবে সে সম্পর্কে দেশের বোদ্ধা নাগরিক সমাজে চলছে নানা আলোচনা।
এ সকল আলোচনায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস ও দুর্নীতি দমনকে বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ছোট শিল্পগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আয়ের পথ বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়ের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার পরামর্শও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও দুদক এর মত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা কাটিয়ে সময়োপযোগী এবং কার্যকারী করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে এ সকল পরামর্শ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
নতুন সরকার গঠনকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত প্রতিশ্রুতিগুলোতেও এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। তবে সর্বাগ্রে স্থান পাওয়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
এর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার রোধ, পশ্চিমের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও আস্থার জায়গাটিকে শক্তিশালী করে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে তা কাজে লাগানো জরুরি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে হলে এ সকল দিকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার গঠনকারী দলটির দেয়া নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সামগ্রিক উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়ন এখন নতুন মন্ত্রিসভার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য মন্ত্রিসভায় নবীন ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের সন্নিবেশন ঘটানো হয়েছে।
নব গঠিত এই সভার সম্মিলিত প্রচেষ্টা সংকট ও সমস্যা সমাধানে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, তা সময় বলে দেবে। তবে শপথ গ্রহণের পর নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনসেবা মানুষের দোর গোঁড়ায় পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা।
বর্তমান মন্ত্রিসভা জনগণের আশা পূরণে সক্ষম হবে বলেও তারা মনে করেন। কিন্তু দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতি একদিকে মানুষের সঞ্চয় সংকোচিত করেছে অন্যদিকে পুরোনো সঞ্চয় ভেঙ্গে তা দিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ ও সন্তানের লেখাপড়ার কাজে ব্যয় করছে। ফলে রাষ্ট্রের নিকট থেকে প্রাপ্য খাদ্য ও শিক্ষার ন্যায় মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার জায়গায় বিশ্বাসের ফাটল ধরেছে।
তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে চলমান যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদের যে আবহ দৃশ্যমান হচ্ছে তা মোকাবেলা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা ও উন্নয়নে সক্রিয় থাকাও সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে একটি উন্নত সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নতুন মন্ত্রিসভা ও নির্বাচনে জিতে আসা জনপ্রতিনিধিরা তাদের প্রজ্ঞা ও মেধা ও ইচ্ছাকে কাজে লাগাবে, দেশের সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখবে এবং এ সকল ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের নজীর তৈরি করবে বলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
এ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের এবং ক্ষমতায় আসা দলের প্রতিনিধিদেরকে প্রতিহিংসা, সহিংসতার রাজনীতি পরিহার করে একটি সুস্থ ও উন্নয়নধর্মী এবং মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ লালন এবং দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)