কাজী সালাউদ্দিন ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি হন। কিংবদন্তি দায়িত্ব নেয়ার পর লাল-সবুজের নারী ফুটবলে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। এসেছে বহু চ্যালেঞ্জ। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশের ফুটবলে এসময়ে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির কেমন মেলবন্ধন ঘটেছে, আগামীতে দেশের ফুটবলকে যেখানে দেখতে চান, সেজন্য যা যা আবশ্যক, কী পরিকল্পনা বাফুফের, তা জানিয়েছেন সাবেক এ স্ট্রাইকার।
বাফুফে সভাপতি বলেছেন, দীর্ঘদিন ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিলেও নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন। বলেছেন, দেশের ফুটবল সমর্থকদের পাশে না পাওয়া থেকে শুরু করে সরকারি সহায়তার অভাবের কথা। সঠিক সময়ে গণমাধ্যমেরও সঠিক ভূমিকা দেখছেন না তিনি। শুক্রবার বাফুফের পাঠানো এক বিবৃতিতে এমন জানিয়েছেন দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাটির প্রধান।
পাঠকদের জন্য বাফুফের পাঠানো কাজী সালাউদ্দিনের প্রশ্ন-উত্তর সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হল।
বিগত ১৫ বছরে, আপনার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কি ছিল?
সালাউদ্দিন: হ্যাঁ, অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল সবসময়ই তহবিলের অভাব। আপনি যদি লক্ষ্য করেন ইংলিশ বা ইউরোপিয়ান লিগে একজন মাঝারি মানের খেলোয়াড়ও প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০ মিলিয়ন টাকা পায়। এশিয়ান লিগগুলোতে, বিশেষ করে অর্থনীতির বিকাশের সাথে সাথে সৌদি, কোরিয়ান ও জাপানিরা আসার সাথে সাথে খেলোয়াড়রা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩-৪ মিলিয়ন টাকা পান। যেটা বিশাল। একজন ভালো মানের কোচের জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করতে হয়।
দেখুন, দেশের ফুটবলের উন্নয়ন করতে হলে শুধু ফেডারেশন নয়; গণমাধ্যম, জনগণ, সমাজব্যবস্থা, ক্লাব, খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতাও প্রয়োজন। সকলকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে।
আপনি যদি একটি ভালো লিগ টুর্নামেন্ট চান- আমি এখানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো কিছু উল্লেখ করছি না। আমাদের পাশের দেশ ভারত, তারা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে লিগ আয়োজন করে। রিলায়েন্স প্রথম বছর ইন্ডিয়ান সুপার লিগের আয়োজন করে এবং তাদের ৭০০ কোটি ভারতীয় রুপী ব্যয় হয়। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হল ফেডারেশনের ভূমিকা কি হওয়া উচিত লোকজন তা বুঝতে পারে না।
বাফুফের তখন কী করার কথা?
সালাউদ্দিন: ফেডারেশনের ভূমিকা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা একটি চ্যালেঞ্জ। সেই ভূমিকা কি? বাফুফের কাজ হল লিগ এবং টুর্নামেন্টের আয়োজন করা। তাছাড়া জাতীয় দল যখন বিদেশ সফরে যায়, আমরা তাদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করি, তাদের প্রশিক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত করি এবং একজন জাতীয় কোচ নিয়োগ করি। এগুলো মূলত ফেডারেশনের প্রাথমিক দায়িত্ব। তারপরে ফেডারেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ম্যাচগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফিফার আইন ও নির্দেশনা মোতাবেক টুর্নামেন্টগুলোর শৃঙ্খলা এবং বিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
বাফুফের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং রেফারির মান উন্নয়ন। এছাড়া ক্লাব বা জাতীয় দলে কাজ করার জন্য কোচদের যে এএফসি লাইসেন্সের প্রয়োজন, তা বাফুফে থেকে দেওয়া হয়। সাউথ এশিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মাত্র দুই সদস্য দেশ– বাংলাদেশ ও ভারত এবং এশিয়ায় ১২টি সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কোরিয়ার মতো বাংলাদেশ এখন প্রফেশনাল ডিপ্লোমা সেই সাথে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ কোচিং লাইসেন্স ইস্যু করতে পারে। গোল কিপিংয়ে বিএফএফয়ের শীর্ষ সদস্যপদ রয়েছে ও গোল কিপিংয়ে ‘এ’ ডিপ্লোমা। বাফুফে ‘বি’ এবং ‘এ’ ডিপ্লোমা লেভেল কোর্সের আয়োজন করতে পারে।
কিন্তু জাতীয় দল গঠন করা ফেডারেশনের দায়িত্ব নয়। আমি আপনাদেরকে একটা উদাহরণ দেই, ২০১৭ সালে ভারতে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন হয়েছিল। আমিও সেখানে ছিলাম। সানচেজ নামে একজন খেলোয়াড় ছিল, সে ইংল্যান্ডের প্রথম একাদশের হয়ে খেলেছিল এবং ফাইনালেও প্রথম একাদশে খেলার কথা ছিল। কিন্তু তাকে খুঁজে পেলাম না। এমনকি সে স্কোয়াডেও ছিল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম তার কি হয়েছে? ব্যাপারটা হল সে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড একাডেমির খেলোয়াড় ছিল। আর একাডেমি তাকে ডেকেছে ফলে তাকে টুর্নামেন্ট থেকে চলে যেতে হয়েছিল এবং তারপরে ধারাভাষ্যকাররা দলগুলো নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এটি ছিল স্পেন বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ। তারা খেলোয়াড়দের সম্পর্কে বলছিলেন যে, চারজন রিয়াল মাদ্রিদের, পাঁচজন বার্সেলোনার, তিনজন ভ্যালেন্সিয়ার এবং চারজন অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ একাডেমির। সুতরাং, এই খেলোয়াড়রা সবাই ক্লাব একাডেমির। আপনারা দেখতে পাবেন যে ইংলিশ জাতীয় দলেরও বড় প্রশিক্ষণ কাঠামো নেই। তাদের যা কিছু সুযোগ-সুবিধা আছে তা হল খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেয়া, যা তারা অধিকাংশ ক্যাম্পেই পান। তাই খেলোয়াড় তৈরি করা ফেডারেশনের কাজ নয়।
সারাবিশ্ব থেকে বার্সেলোনা একাডেমিতে প্রায় ৪০,০০০ নিবন্ধিত খেলোয়াড় রয়েছে। সব ক্লাবেই এমন ব্যবস্থা আছে। এভাবেই খেলোয়াড়দের গড়ে তোলা হয়। তারা জেলা ফুটবলের উপর জোর দেয়, যেন খেলোয়াড়দের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এটা যাতে না হয় সেজন্য তুমি তোমার কাজ করো। আমি তোমাকে সমর্থন করবো, আমি প্রযুক্তিগত সহায়তা করব এবং সম্ভব হলে আর্থিক সহায়তা দেবো। ফেডারেশন প্রশিক্ষণ এবং রেফারি লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা করবে। অবশ্যই, আমরা তাদের সহায়তা করি এবং করবো, তবে সেটা আমাদের ম্যান্ডেট বা খেলার অফিসিয়াল নিয়ম মেনে।
অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলো কি?
সালাউদ্দিন: বর্তমানে ঢাকায় ফিফার মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো স্টেডিয়াম নেই। ছয় মাসের জন্য ঢাকা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম নেয়া হয় সংস্কারের জন্য এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তাদের এখনও সংস্কার কাজ চলছে। এবছর বেঙ্গালুরুতে সাফ টুর্নামেন্ট হচ্ছে। আমাদের হোস্টিং করার কথা ছিল। কিন্তু মাঠ না থাকায়, আমরা তা পারিনি। এমনকি আর্জেন্টিনাকেও তাদের সফর বাতিল করতে হয়েছে। সবকিছু চূড়ান্ত হলেও খেলার জন্য মাঠ ছিল না।
সাধারণত, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামকে ফুটবলের জন্য দেয়া হয় এবং সরকার সেখানে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, এটা অনেক ভালো। তবে সেই স্টেডিয়ামটি ২০২১ সাল থেকে সংস্কার করা হচ্ছে।
আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? দেশের কোথাও কি কোন স্টেডিয়াম নেই?
সালাউদ্দিন: ভেন্যুর ক্ষেত্রে এএফসি থেকে একটি যথাযথ মানদণ্ড বেধে দেয়া হয়, যা আমাদের মেনে চলতে হয়। সে অনুযায়ী শুধু সিলেট জেলা স্টেডিয়াম, ঢাকা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও কমলাপুর স্টেডিয়াম মেনে চলে। আমি আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার করা হচ্ছে এবং কমলাপুর স্টেডিয়ামে কৃত্রিম ঘাস থাকায় সেখানে শুধুমাত্র নারী ও যুবকরা খেলতে পারবেন এবং সিলেট স্টেডিয়ামের ক্ষেত্রে আমাদের তখন ভ্রমণে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে। ফিফা নীতি অনুসারে তারা ভেন্যুর কাছাকাছি সরাসরি ফ্লাইট পছন্দ করে।
এখন অন্য কথায় আসি, আমরা দলকে অনুশীলনের জন্য সৌদি আরব পাঠানোয় অনেকেই আমার সমালোচনা করছে। আপনি দেখবেন যে, খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের উপযুক্ত মাঠ নেই। যদি আমি প্রশিক্ষণের আয়োজন করি, তাদের প্রয়োজনীয় রসদ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা এখানে সহজে সম্ভব নয়। আমরা সৌদির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি যে, তারা আমাদের রাখতে ইচ্ছুক কিনা। সৌদির ফুটবল ফেডারেশন আমাদের একটি হোটেলে রাখতে, একটি মাঠ এবং টিকিটের একটি অংশ সরবরাহ করতে রাজি হয়েছিল। আমরা এটি বেশ কয়েকবার করেছি, আমি বলব ১০-১২টি ট্রিপ। আমরা মেয়েদের চীন, কোরিয়া, জাপানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি, ছেলেরা নিয়মিত কাতার ও সৌদিতে যায়। এইসব দেশের ফেডারেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্কের কারণে সম্ভব হচ্ছে।
এসব অবকাঠামোগত সুবিধা ছাড়াও তহবিলের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি একটা শক্তিশালী জাতীয় ফুটবল দল গড়ে তুলতে হলে বছরব্যাপী ফুটবল প্রশিক্ষণ, প্রতিযোগিতার আয়োজন করার প্রস্তাব আমরা দেই। কিন্তু তা এখনও মন্ত্রণালয়ে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।
মূল উদ্দেশ্য হল নতুন প্রতিভাবান ও উদীয়মান খেলোয়াড় খুঁজে পেতে ক্লাব ভিত্তিক এবং তৃণমূল পর্যায়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ শিবির, আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন করা এবং ৪টি বাফুফে একাডেমি পরিচালনা করা।
আপনি বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচারণার কথা বলছেন। আপনি কি এর বিস্তারিত বলবেন?
সালাউদ্দিন: আপনি যদি টকশোগুলো দেখেন, আপনি ফুটবল নিয়ে কথা বলতে এমন লোকদের দেখতে পাবেন যারা সম্ভবত গত পাঁচ বা সাত বছরে স্টেডিয়ামে গিয়ে একটি ম্যাচও দেখে নাই। তাদের বক্তব্য ও অভিযোগ অস্পষ্ট। তাদের মন্তব্য তারা নিজেরা যা দেখছেন তার উপর ভিত্তি করে নয়। কিন্তু তাদেরকে টকশোতে নিয়মিত আনা হয় ফেডারেশনের বদনাম ও সমালোচনা করার জন্য। গত কয়েক বছরে তারা সত্যিই কোনো খেলা দেখে নাই এবং আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন সর্বশেষ কবে খেলা দেখেছেন, তারা আপনাকে বলবে যে, তারা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে শুনেছেন ও দেখেছেন।