কক্সবাজারের টেকনাফ বাহারছড়ার জাহাজপুরা পাহাড়ে অপহরণ হওয়া ৮ বাংলাদেশি ৩ দিন পর আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেন।
গহীন পাহাড়ের ভাজে ভাজে রয়েছে অসংখ্য গুহা (সুড়ঙ্গ)। আর এসব গুহাকে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে সশস্ত্র অপরাধীরা অপহরণ করে ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে তিন দিন পর মধ্যরাতে ঘরে ফেরা কক্সবাজারের টেকনাফের অপহৃত ৮ জনকে। পাহাড়ের যে খালে মাছ ধরে গিয়ে ছিলেন ওখান থেকে অনুমানিক ১০ কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ে রয়েছে এসব গুহা। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রে রোহিঙ্গাদের সাথে রয়েছে বাংলাদেশিও। গহীন পাহাড় হলেও ওখানে অপরাধী চক্রের প্রধান সহ কয়েকজন ব্যবহার করে ল্যাপটপ সহ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ডিভাইস। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য জানতে পারে চক্রটি।
টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহৃত ৮ জন ফেরার পর সংশ্লিষ্টদের স্বজনরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
অপহরণে শিকার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বুধবার দিবাগত রাত ২টায় ৮ জন ঘরে ফিরেন। ঘরে ফেরার পর স্বজনরা খুব কম সময় তাদের সাথে আলাপ করতে পেরেছেন। পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদেরকে হেফাজতে নিয়ে যান।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬ টা) ওই ৮ জন পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। তবে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেয়ার পর এদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন উদ্ধার হওদের স্বজনরা। তবে পুলিশ মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর রোববার বিকালে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার একটি পাহাড়ের ভেতর খালে মাছ ধরতে গেলে অস্ত্রধারী একদল অপহরণকারী এক কলেজ শিক্ষার্থীসহ ৮ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর অপহরণকারীরা অপহৃতদের স্বজনদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকার মুক্তিপণ দাবী করেছিল।
এই ৮ জন হলেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, তার ভাই করিম উল্লাহ, মমতাজ মিয়ার ছেলে মো রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সলিম উল্লাহ, কাদের হোসেন ছেলে নুরুল হক, রশিদ আহমদের ছেলে নুরুল আবছার ও নুরুল হকের ছেলে নুর মোহাম্মদ।
তারা বুধবার দিবাগত রাত ২টায় ঘরে ফিরেছেন। যার মধ্যে মোস্তফা ও করিমের বড় ভাই মোহাম্মদ উল্লাহ বৃহস্পতিবার দুপুরে জানিয়েছেন, অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ভাই যে তথ্য দিয়েছেন তাতে গহীন পাহাড়ে আস্তানা তৈরী করে অবস্থান নেয়া অপরাধী চক্রের হাতে রয়েছে অসংখ্য ভারী অস্ত্র। তাদের সংখ্যা ২২ থেকে ২৫ জন হলেও অস্ত্রের সংখ্যা আরও বেশি। পাহাড়ের গুহায় গুহায় রাখা হয়েছিল অপহৃতদের। যেখানে চালানো হয়েছে নির্যাতন। অপহরণকারীদের ৩ জন ছাড়া সকলেই মুখোশ পরিহিত ছিলেন। যে তিন জন মুখোশ পড়েননি তারা রোহিঙ্গা। মুখোশ পরিহিতরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেছেন এবং চক্রের প্রধানকে ‘মেজর’ বলে সম্বোধন করেছেন। এরা বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন তিনি।
মোহাম্মদ উল্লাহ ফেরাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান, গহীন পাহাড়ে অবস্থান নেয়া এ চক্রের সদস্যরা ল্যাপটপ ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখেছেন অপহৃতরা। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য তারা জানতেন।
মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, অপহৃত ৮ জনের পরিবার মিলে একটা অংকের টাকা পাঠানোর পর ৮ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে এই টাকার অংক কত এবং কিভাবে পাঠানো হয়েছে এব্যাপারে তিনি কোন তথ্য দেননি।
মোস্তফা ও করিমের অপর ভাই টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া অপহরণ মামলার বাদি হাবিব উল্লাহ জানান, ফেরার পর তারা যে তথ্য প্রদান করেছেন তাতে গহীন পাহাড়ে অপরাধীদের খাবার সরবরাহে একজন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। যিনি তাদের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে যান এবং মাঝে-মধ্যে রান্না উপকরণ নিয়ে গিয়ে রান্না করে দেন এই বয়স্ক লোক। যাকে সকলেই ‘বাবা’ বলে ডাকেন। ৮ জন অপহরণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ে অভিযান চালানোর সময় প্রায় কাছা-কাছি স্থানে পৌঁছে ছিলেন। আরও কিছু এগিয়ে গেলে হয়তো অপহরণকারিদের পাওয়া যেত।
হাবিব জানান, ফেরত আসা ৩ জনকে সাথে নিয়ে পুলিশ পাহাড়ের ওই আস্তানায় অভিযানে গেছে। এর বিস্তারিত তিনি জানেন না।
বাহাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন, পাহাড় ঘীরে একটি অপরাধী চক্রের শক্ত অবস্থান রয়েছে। যারা গত ৫ মাসে বাহারছড়া ইউনিয়নের ১৫-২০ জনকে অপহরণ করেছে। এবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযান দেখা গেছে। এটা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫ টায় কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং করেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম। ওই সময় অপহৃত ৮ জনকে ওখানে আনা হয়।
ব্রিফিং এ পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৩ দিন পর অপহরণকারি চক্রের কাছ থেকে ফেরা ৮ ব্যক্তির সাথে আলাপ করে পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করেছে। অপহরণের পর এদের পরিবার থেকে মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছিল। ওই সব পরিবারের সাথে কথা বলে পুলিশের পাহাড়ে অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের পুলিশ স্থানীয়দের সাথে নিয়ে পাহাড় ঘীরে রাখে। যার ভয়ে এদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার জানান, মুক্তিপণ দাবী করলেও অপহৃতরা কোন মুক্তিপণ দেননি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। এই পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে অপহরণকারিরা রোহিঙ্গা না বলে জানা গেছে। ওই চক্রের সদস্য বাংলাদেশী নাগরিক। এ ব্যাপারে মামলার ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘অপহৃতদের উদ্ধারের জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আমরা পাহাড়ে ড্রোন উড়িয়ে দুর্বৃত্তদের অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। দিনরাত উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছি। অবশেষে অপহরণকারীরা ভুক্তভোগীদের ছেড়ে দেয়।
তবে ফেরত আসা নুরুল আবছার জানিয়েছেন, অপহরণকারি চক্রের সদস্যের মধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে। পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালানো শুরু করলে তাদের অন্য পাহাড়ে নিয়ে যায়। এই সময় আবছার সহ ২ জনকে আটকে রেখে ৬ জনকে টাকা আনতে ছেড়ে দেয়।
ওই সময় অপহরণকারিরা জানান রাতের মধ্যে টাকা না দিয়ে ২ জনকে মেরে ফেলা হবে। যে ৬ জনকে ছেড়ে দেয়া হয় তারা ঘরে এসে সকলের পরিবার থেকে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে আবার পাহাড়ে যায়। টাকা পাওয়ার পর এদের ছেড়ে দেয়া হয়।
ফেরত আসা মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, অপহরণকারিরা সশস্ত্র এবং বেশিভাগ মুখোশ পরিহিত। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী রয়েছে।