বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষদিকে রাজনীতিকে উত্তাল করে তুলেছিলেন বিরোধী রাজনীতিকরা। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের বিরুদ্ধে একদিকে ছিল বামপন্থী রাজনীতিকদের একটি অংশ, অন্যদিকে কিছু সশস্ত্র গ্রুপ।
সেই সময়কার ঘোর বিরোধী রাজনীতিবিদদের বয়ানেও উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার কথা। নিজ দলের নেতাকর্মীদের হাতে ঘেরাও হওয়া রাজনীতিককেও যেকোন মূল্যে বাঁচানোর নির্দেশ দিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
এমনই এক ঘটনার বিবরণ ‘আমার রাজনীতির ৬০ বছর: জোয়ার-ভাটার কথন’ বইয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বেঁচে আসা সেসময়ের বাম রাজনীতিক ও পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ।
বইয়ের ২৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি স্বীকার করেছেন: ‘এখানে আমি যে কথাটা বলতে চাই তা হলো শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক সমালোচনা আমাদের আছে। কিন্তু এ কথা সত্য, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন। সেজন্য সকল রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা ছিল। যখনই তিনি দেখেছেন আমার জীবন হুমকির মুখে তখনই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তা করেছেন। রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তার যে ভালোবাসা, স্নেহ মমতা ছিল সে কারণেই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। এটা তাঁর হৃদয়ের একটা ঔদার্য, বিশালতা এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।’
কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী রাজনীতিককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে নিজ দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে থানার একজন ওসিকে সরাসরি ফোন দিয়ে বঙ্গবন্ধু যেকোন কিছু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তখনকার ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি)’র শীর্ষ নেতা কাজী জাফর আহমদ।
তিনি বলেন: একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। টঙ্গীর টেলিফোন শিল্প সংস্থার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর মজুমদারকে শ্রমিক লীগ ও আওয়ামী লীগের বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তখন ধরে নিয়ে যাওয়ার অর্থই হলো নিশ্চিত মৃত্যু। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমি সেদিন টঙ্গীতে উপস্থিত ছিলাম। আলমগীর মজুদমদার শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে একজন সচেতন কর্মী ছিলেন। তার জীবন রক্ষা করার জন্য আমি শ্রমিকদের মিছিল করে টঙ্গীর মিলবাজারে যাওয়ার অনুমতি দেই। টঙ্গীর হাজার হাজার শ্রমিক হাতে যা পেয়েছে তা নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। শ্রমিকদের কাছে খবর এলো আওয়ামী লীগ অফিসের দোতলায় কিংবা তিন তলায় আলমগীর মজুমদারকে হত্যা করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক সেখানে পৌঁছলে আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। শ্রমিকরা আলমগীর মজুমদারকে উদ্ধার করে তাকে কাঁধে নিয়ে উল্লাস করতে করতে মিল ব্যারাকে ফিরে আসে।’
কাজী জাফর তার বইয়ে বলেছেন: সেই সময় শ্রমিকরা এক অনাকাক্ষিত কাজ করে বসে। আওয়ামী লীগের অফিসের দোতলা, তিনতলা এবং বেজমেন্টে থাকা রিলিফের কম্বল নিয়ে চলে আসে। সেই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
সেই কম্বলগুলো শ্রমিকদের লুণ্ঠন করতে না দিয়ে এক ধরনের অনশন করে শ্রমিকদের কাছ থেকে জমা নিয়ে দুঃস্থ, বাস্তুহারা মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন বলে দাবি করেন কাজী জাফর আহমদ।
স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা এবং সেখান থেকে কম্বল লুট করে নেওয়ায় পিছু হটে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধীপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
কাজী জাফর আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাকশালের বিরোধিতাকারী একজন বামপন্থী নেতা। এমনকি বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য বামপন্থী নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি নিজ দল থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। পরবর্তীতে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দলও তৈরি করেন।
টঙ্গীর সেই ঘটনা উল্লেখ করে তিনি তার বইয়ে লিখেন: ‘আমি তখন মন্নু টেক্সটাইল মিলের জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে ছিলাম। বাইরে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ হচেছ। আমি যেখানে বসেছিলাম সেই কক্ষের দেয়ালে গুলি আঘাত করছে। এই ঘটনায় দু’জন শ্রমিক নিহত হলো। অনেক শ্রমিক আহত হলো। ঠিক এই অবস্থায় আমি দেখলাম হামলাকারীরা দুই দিক থেকে এগিয়ে আসছে। আমি যে মন্নু টেক্সটাইল মিলের জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে আছি এটা তাদের জানা ছিল।
কাজী জাফরের আশঙ্কা ছিল হামলাকারীরা যেকোন মুহূর্তে সেখানে প্রবেশ করবে। তাকে পেলে ধরে নিয়ে যাবে অথবা সেখানেই হত্যা করবে। এমন অবস্থায় কোন উপায় না দেখে তিনি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে টেলিফোন করেন। বঙ্গবন্ধু বাসায় না থাকলেও সেসময় তিনি বাইরে থেকে ফিরছিলেন এবং বাসায় ঢুকে টেলিফোন ধরেন।
কাজী জাফর লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বললেন: কাজী জাফর তোমার এত স্পর্ধা হয়েছে? আইয়ুব যেটা পারে নাই, ইয়াহিয়া যেটা পারে নাই, টিক্কা যেটা পারে নাই, তুমি আজকে আমাদের আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা করেছ এবং আওয়ামী লীগ অফিস থেকে রিলিফের জিনিসপত্র নিয়ে গেছ, আমার অনেক মানুষকে হতাহত করেছ।”
কাজী জাফর কিছু বলার আছে জানালে তিনি বললেন, বলার কিছু থাকলে তুমি আমার কাছে আসতে পারতে। আমি তো তোমাকে রিফিউজ করিনি। আমার কাছে আস, সামনাসামনি কথা হবে।
কাজী জাফর বললেন, যদি বেঁচে থাকি তাহলে দেখা হবে।
এবার বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি এখন কোথায়? টঙ্গীতে মুন্নু টেক্সটাইল মিলের জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে এবং গুলির শব্দ হচ্ছে জানানোর পর তিনি টেলিফোন নাম্বার চাইলেন।
‘১৫-১৬ মিনিট পর তিনি টেলিফোন করলেন। বললেন, কাজী জাফর আমি যে কাউকে পেলাম না। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা অন্য কারো সাথে কথা বললে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমি টঙ্গী থানার ওসির সাথে সরাসরি কথা বলেছি। আমি তাকে বলেছি, তুমি এক্ষুণি যাও। আমি কাজী জাফরের সাথে সাক্ষাতের সময় দিয়েছি বিকেল ৫টায়। তুমি সসম্মানে তাকে নিয়ে আসবে। এর জন্য যা যা প্রয়োজন তোমাকে তা করতে হবে’, বইয়ে উল্লেখ করেছেন কাজী জাফর আহমদ।
তিনি জানান, টঙ্গী থানার ওসি মুহূর্তের মধ্যে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে ছুটে এলো। দুই-তিন ট্রাক পুলিশ সে নিয়ে এসেছে। টঙ্গীতে তখন শুধু থানার পুলিশ নয়, রিজার্ভ বাহিনীও মোতায়েন থাকত। ওসি আর কারো দিকে না তাকিয়ে খুব দ্রুত একতলার ছাদে উঠে গেল। ছাদে উঠেই তার বাহিনী পাল্টা গুলি শুরু করল।
এ বিষয়টি কাজী জাফরের কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। তিনি বলেন: এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। পুলিশ আমাদের পক্ষে গুলি করছে! তারাও বেশকিছু হতাহত হলো। পরে শুনেছি দুজন পুলিশ মারা গেছে। অনেকে আহত হয়েছে। ওসি বেলায়েত হোসেন আমার কাছে এলো। আমাকে বলল, বঙ্গবন্ধু আমাকে নিজে টেলিফোন করেছেন। আপনাকে সসম্মানে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সে তখন আবেগে থরথর করে কাঁপছিল।
কাজী জাফর লিখেছেন: পুলিশ আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ কর্মীদের ওপর পাল্টা গুলি চালানোর পর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। সেদিন সম্ভবত টঙ্গীতে জামাল হায়দার, হায়দার আকবার খান রনো, আব্দুল হালিম প্রমুখ উপস্থিত ছিল। তারাও আমার সাথে পুলিশের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি।