১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থান করায় বেঁচে যান। ঠিক কী জন্য ওইসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামে গিয়েছিলেন, তার রয়েছে এক দারুণ পারিবারিক প্রেক্ষাপট।
শেখ হাসিনার স্বামী ও দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” বইয়ে বিষয়টির ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়েছেন। তার লেখায় উঠে এসেছে ১৫ আগস্টের আগে-পরের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানির শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কার্লসরুয়ে প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে (Karlsruher Institut für Technologie) উচ্চতর ট্রেনিং নিতে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। স্কলারশিপের অন্যতম শর্ত ছিল ট্রেনিং চলাকালে পরিবার নিয়ে আসা যাবে না এবং তিনি কোন ছুটি পাবেন না। সেবছর জুলাই মাসে শেখ কামালের বিয়েতে উপস্থিত হতে শাশুড়ি বেগম ফজিলাতুন নেছার টেলিগ্রাম পেয়েও দেশে আসা হয়নি বঙ্গবন্ধু জামাতার। তারপরে বঙ্গবন্ধু আচমকা ফোন করেন জানিয়ে শেখ হাসিনার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আকারে তার বইতে লিখেছেন ওয়াজেদ মিয়া।
তিনি লিখেছেন, “১৭ই জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমি অফিস থেকে কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসের আমার কক্ষে পৌছাই। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমাকে জানানাে হয় যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অতঃপর ফোন এলে আমি উদ্বিগ্নাবস্থায় টেলিফোন রিসিভ করি। ফোনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনে আমি ‘আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন?’ বলি। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলেন না বলে লন্ডনের লাইনে তিনি পুনরায় ফোন করবেন বলে আমাকে জানান। এর একটু পরে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ফোন আসে। বুঝা গেল এবার তিনি আমার কণ্ঠ পরিষ্কারভাবে শুনতে পাচ্ছেন। তিনি কেমন আছেন, আমি জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু একটু ক্লান্তস্বরে টেনে টেনে বললেন, ‘বাবা, ভাল আছি।” তাঁর শরীর কেমন আছে আমি জানতে চাইলে তিনি আবারও টেনে-টেনে বললেন যে, শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ, হাসিনা, আমার ছেলেমেয়ে, শাশুড়ি, কামাল, জামাল, রেহানা ও রাসেলসহ বাড়ীর সবাই ভাল আছে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জানান যে, কামালের বিয়েতে আমি উপস্থিত না হওয়ায় শাশুড়ি ভীষণ দুঃখ পেয়েছেন। আমি তখন ভীষণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যে পরিস্থিতির কারণে দেশে ফিরতে পারিনি তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে জানাই।”
পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পিতৃটান এবং পরিবারসহ শেখ হাসিনার বিদেশে যাওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: বঙ্গবন্ধু আমাকে আরও জানান যে, রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা আমাদের ছেলেমেয়েদেরসহ জুলাই মাসের শেষের দিকে জার্মানি চলে আসবে। আর কয়েক মাস পর আমি দেশে ফিরতে পারি বিধায় হাসিনার অতাে টাকা পয়সা খরচ করে তখন জার্মানি চলে আসা সমীচীন হবে না, আমি একথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তােমার ছেলে জয়কে কিছুতেই বুঝানাে যাচ্ছে না। ও সারাক্ষণ তােমার কথা বলে, তােমার খোঁজ করে এবং তােমার কাছে যেতে চায়। অতএব, তুমি আর কোন আপত্তি ওঠাইও না।” এ কথাগুলাে বলে বঙ্গবন্ধু আমাকে তখন হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। হাসিনাকেও আমি একই কথা বলি। হাসিনাও আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাে বলে। হাসিনা আমাকে এও বলে যে, আমি যতােই আপত্তি করি না কেন, সে জার্মানি চলে আসবেই। এই কথােপকথনে প্রায় বিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। এরপর কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমি ফোনের রিসিভার রেখে দিই।
তিনি আরো লিখেছেন, ১৯শে জুলাই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব জনাব মশিয়ুর রহমান আমার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা ২৫শে জুলাই তারিখে প্যানামের একটি ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌছাবে। তিনি আমাকে উক্ত ফ্লাইটের নম্বর ও সময়সূচীও জানান। ২০শে জুলাই তারিখে জনাব মশিয়ুর রহমান সাহেব আবার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা উক্ত ফ্লাইটে যাচ্ছে না কারণ সেটি করাচী হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট যায়। তিনি আমাকে আরও জানান যে, পরিবর্তিত সফরসূচী অনুযায়ী হাসিনারা লুফথানসার একটি ফ্লাইটে ৩০শে জুলাই সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌছাবে।
অনেকদিন পরে বিমানবন্দরে পরিবারকে কাছে পাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: (পশ্চিম) জার্মানিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি, জনাব আমজাদুল হক। আমরা দু’জন ভাের সাড়ে সাতটার দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে পৌছাই। ঐ দিনে লুফথানসার ফ্লাইটটির ল্যান্ড করার কথা ছিল সকাল সােয়া আটটায়। কিন্তু সেটি নির্ধারিত সময়সূচীর পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে পৌছে যায়। যাহােক, আমজাদুল হক ও আমি তাড়াতাড়ি সেখানের ভিআইপি লাউঞ্জে চলে যাই। এর কয়েক মিনিট পূর্বে জার্মান কর্তৃপক্ষের লােকজন হাসিনা-রেহানাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছেন। যাহােক, আমাকে দেখে বাচ্চারা ভীষণ খুশী হয়। ওদের মালপত্র সেখানে নিয়ে আনার পর দেখি যে, হাসিনা তার নামের সঙ্গে আমার নাম সংযােজন করে নতুন পাসপাের্ট ইস্যু করে নিয়েছে। নতুন পাসপাের্টে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, “হাসিনা শেখ ওয়াজেদ” বলে। উল্লেখ্য যে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রেও তার নাম রয়েছে ‘হাসিনা শেখ’ বলে। ১৯৬৯-এ আমার সঙ্গে ইটালি যাওয়ার সময় তার জন্য এই শেষােক্ত নামেই পাসপাের্ট ইস্যু করে নেওয়া হয়েছিলাে। এ ব্যাপারে আমি হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “তুমি যদি বিমান বন্দরে না আসাে সেজন্য ইচ্ছা করেই এই পাসপাের্টে তােমার নাম সংযােজন করে নিয়েছি। যাতে কার্লসরুয়ে শহরে গিয়ে সহজেই তােমাকে খুঁজে বের করা যায়। স্মরণ রাখবা, তুমি যেমন বুনাে ওল আমিও তেমনি বাঘা তেতুল।” যাহােক, একটু চা-নাস্তা খাওয়ার পর আমজাদুল হকের গাড়ীতে আমরা কার্লসৰুয়ে শহরের উদ্দেশে রওনা দিই।
আগস্ট মাসের শুরুতে বাংলাদেশের কিছু ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ৬ই আগস্ট কতিপয় দুষ্কৃতকারীর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে হাতবােমা নিক্ষেপের ঘটনায় ৩ ব্যক্তি নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। ৮ই আগস্ট প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করার সংবাদও দ্রুত জানাজানি হয়ে যায়। ঐদিন বিকেলে হাসিনা, রেহানা ও বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কার্লসরুয়ে শহরের প্রধান বিপণী কেন্দ্র পরিদর্শনে যাই। প্রথমে এদের সবার জন্য কিছু জামা-কাপড় কেনা হয়। অতঃপর একটি জুতাের দোকানে গিয়ে দেখি সেখানে হ্রাসকৃত মূল্যে সুন্দর সুন্দর জুতাে পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকের জন্য জুতাে নির্বাচন করার সময় হাসিনা জয়ের জুতাের একই ডিজাইন ও রংয়ের এক জোড়া জুতা নেয় রাসেলের জন্য।
জার্মানিতে পরিবার নিয়ে আনন্দময় সময়ের বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু জামাতা লিখেছেন, ৯ই আগস্ট (১৯৭৫) তারিখে (পশ্চিম) জার্মানিস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বিশেষ আমন্ত্রণে আমি রেহানা-হাসিনাদের সঙ্গে নিয়ে রাজধানী বনে যাই। রাষ্ট্রদূতের অফিসিয়াল বাসভবনে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বনের কনিংসউইটারস্থ একটি টিলার ওপর অবস্থিত তাঁর তিনতলা বাসভবনটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা লন্ডনে পড়াশুনারত থাকায় বাসাটির কয়েকটি শয়নকক্ষ খালি ছিল তখন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের পরামর্শ দেন ঐ সময়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস ও ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস বেরিয়ে আসার জন্য। সেই মােতাবেক তিনি বেলজিয়ামস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব সানাউল হকের সঙ্গে আলাপ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সানাউল হক সাহেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অতএব তিনি উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। এরপরে ১১ই আগস্ট সন্ধ্যায় হাসিনা ঢাকায় ওর মা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলে। অতঃপর হাসিনা আমাকে জানায় যে, সেদিন ওর মা’র মন ভীষণ খারাপ ছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর একমাত্র বােনের ছেলে শেখ শহীদের বিয়েতে তাঁকে যেতে না দেয়ায় তিনি ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। হাসিনা আমাকে আরও বলে, “জয়ের এবং উক্ত ঘটনার কথা বলতে বলতে মা ভীষণ কাঁদছিলেন।”
জার্মানি থেকে বেলজিয়ামে যাবার পরের ঘটনা উল্লেখ করে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: ১২ই আগস্ট সকালে আমরা ব্রাসেলসের উদ্দেশে রওনা হই এবং সেখানে পৌছাই বিকেল একটার দিকে। রাষ্ট্রদূতের বাসার তিনতলার দুটো কক্ষে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৩ই আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের হল্যান্ডের রাজধানী হেগ-এ যাওয়ার কথা ছিল সে দেশের সঙ্গে গুড়া দুধ সরবরাহ সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে। এই সুবাদে ১৩ই আগস্ট তারিখে তিনি আমাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যান। হেগ শহরের কাছেই আমস্টারডাম শহরের একটি হোটেলে থাকার বন্দোবস্ত করে তিনি সে দিনই ফিরে যান ব্রাসেলসে বঙ্গবন্ধুকে উক্ত চুক্তির বিষয়ে অবহিত করার জন্যে। ১৪ই আগস্ট বিকেলে আমরা আমস্টারডাম থেকে ব্রাসেলসে ফিরে যাই। ১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা ছিল। এই কারণে ১৪ই আগস্ট রাতে সানাউল হক সাহেবের বাসায় আমাদের জন্যে আনুষ্ঠানিক ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বেলজিয়ান নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিতা এক বাঙালী মহিলা বিজ্ঞানী ও তাঁর বিজ্ঞানী স্বামীকেও দাওয়াত করা হয়েছিল উক্ত ডিনারে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হয় রাত দশটার দিকে। এরপর ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি আনােয়ার সাদাত আমাদেরকে নিয়ে যায় তার বাসায় রাত সাড়ে দশটার দিকে। সেখানে পৌছে হাসিনা বুঝতে পারে যে, আনােয়ার সাদাতের স্ত্রী ওর স্কুলের সহপাঠিনী ছিল। রাত সাড়ে বারােটার দিকে আমরা আনােয়ার সাদাতের বাসা থেকে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের বাসায় ফেরার জন্য উক্ত বাসার দোতলা থেকে নীচে নেমে আসি। যদিও আমি গাড়ীর সামনের আসনে বসেছিলাম, কিন্তু রেহানা-হাসিনারা পেছনের আসনে উঠে দরজা বন্ধ করার সময় আমার বাঁ হাতের সবক’টি আঙুল উক্ত দরজার ফাঁকে আটকে পড়ে মারাত্মকভাবে পিষ্ট হয়। এই দুর্ঘটনায় আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে এটাসেটা ভাবতে থাকি। এক পর্যায়ে পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট তারিখে প্যারিস যাওয়ার কর্মসূচী বাতিল করার প্রস্তাব করি। কিন্তু রেহানা ও হাসিনা আমার প্রস্তাবে রাজি হলাে না।
১৫ আগস্ট সারাদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানির বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দিই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে , হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নীচে দোতলায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা হেঁট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখেও তিনি কোন কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, “আজ ভােরে বাংলাদেশে ‘কু’ হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুণি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন।” “প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে” একথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এর বেশী আপাততঃ আমি আর কিছুই জানি না।” একথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বলেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌছাতেই হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কি বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদেরকে প্যারিস যাওয়ার প্রােগ্রাম বাতিল করে সেদিনই বনে ফিরে যেতে বলেছেন। একথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রেহানা ও হাসিনা দু’জনেই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে, নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে, যা আমি তাদেরকে বলতে চাই না। তারা আরও বলে যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ তাদেরকে পরিষ্কারভাবে না বলা পর্যন্ত তারা ঐ বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। অতএব, বাধ্য হয়েই আমি তাদেরকে বলি যে, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। একথা শুনে তারা দু’বােন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।
তিনি আরও লিখেছেন, ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেন যুগােশ্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট যাত্রা বিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ডঃ কামাল হােসেন ও হমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানাের পর হমায়ুন রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের ওপর তলায় নিয়ে যান। তখন ড্রইং রুমে ডঃ কামাল হােসেন, হমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকণ্ঠিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাঁকে আমি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌছানাে পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোন কিছু জানতে দেবাে না, এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, “বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই।” এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে, তাঁর কাছ থেকে একথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোন দেশ আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়।”
১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পরে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। পরের অভিজ্ঞতা বিষয়ে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: পরদিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য ডঃ কামাল হােসেন বনস্থ বিমান বন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানানাে হয়। ডঃ কামাল হােসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গাড়ীতে উঠে বসি। বিমান বন্দরে ডঃ কামাল হােসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দু’জনে একত্রে কিছু গােপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তে আমি ডঃ কামাল হােসেন সাহেবের হাত ধরে তাঁকে বললাম, “খন্দকার মােশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে আপােষ করে তার মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করবেন না।” আমার এই প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হােসেন আমাকে বললেন, “ডঃ ওয়াজেদ, প্রয়ােজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপােষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।” এই কথাগুলাে বলেই তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুর জামাতা আরও লিখেছেন, বিমান বন্দর থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ফিরে হাসিনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইতিপূর্বে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতাে ভাই মােমিনুল হক খােকা (কাকা) ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমাদেরকে লন্ডনে তাঁর কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছােট ভাই কায়সার রশীদ চৌধুরী তাঁকে ফোন করেন। এই পরিস্থিতিতে খন্দকার মােশতাক আহমদের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার জন্য কায়সার চৌধুরী তাঁকে হুশিয়ার করে দেন। কায়সার রশীদ চৌধুরী, রেহানা ও হাসিনার সঙ্গেও কথা বলে তাদেরকে সান্ত্বনা দেন। অতঃপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, রেহানা, হাসিনা ও আমাকে বলেন যে, লন্ডনে চলে যাওয়া সাব্যস্ত করলে আমরা সেখানে তাঁর বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। তবে তিনি আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, সেখানে মাত্র একটি সমস্যা আছে। ঐ বাসার নীচ তলায় কায়সার রশীদ চৌধুরী বসবাস করে এবং সে ভুট্টোর অন্ধ ভক্ত। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৫ই আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, খন্দকার মােশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে তৎব্যাপারে একাত্মতা ঘােষণা করার জন্য। যাহােক, ঐদিনই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কার্লসরুয়ে পাঠালেন সেখান থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য ভারী জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জার্মানি থেকে সপরিবার ভারতে চলে আসার বিষয়ে এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন: আমি সেদিন কার্লসরুয়ে গিয়ে বনে ফিরে আসি রাত সাড়ে দশটার দিকে। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কোন বইপত্র বা অন্য কোন জিনিসপত্র সঙ্গে আনতে পারিনি। রাত এগারােটার দিকে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁর স্ত্রী ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গাড়ী চালিয়ে বাড়ীর বাইরে যান। পথে তিনি বলেন যে, একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের তাঁর পরিচিত একজন অফিসিয়াল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আমাকে তাঁদের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাহােক, উক্ত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর ভারতীয় সেই অফিসিয়ালের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তাঁর কাছে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে পরামর্শ দেন যে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা শেষে রওনা হওয়ার সময় আমি যেন তাঁকে ফোনে অবহিত করি। অতঃপর ভারতীয় ঐ অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাঁদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মুসলমান জার্নালিস্ট। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাঁকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শােনার পর তিনি আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে কি চাই। অতঃপর তিনি সাদা কাগজ ও একটি কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা শংকায় আমার হাত কাঁপছিলাে। যাহােক, অতিকষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেখপূর্বক সকলের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম, শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতলি এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।”
মাত্র পঁচিশ ডলার সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা জার্মানি গিয়েছিলেন, এবং সেই অবস্থায় কীভাবে জার্মানি হয়ে ভারত গেলেন তার বর্ণনায় ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ১৭ই আগস্ট রােববার হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারাক্ষণ বাসায় ছিলেন। ঐ দিন লন্ডন থেকে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় রেহানা ও হাসিনাকে ফোন করেন। এক সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পত্নী আমাদেরকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইতিপূর্বে কথা বলেছেন এবং তিনি আশ্বাস দেন যে, আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাতে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কি না। আমি তাঁকে জানাই যে, হাসিনারা প্রত্যেকে মাত্র পচিশ ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কার্লসরুয়ে গেস্ট হাউসে আমি রেহানার জন্য একটি পৃথক কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। অতঃপর আমি তাঁকে হাসিনার সঙ্গে ঐবিষয়ে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দিই। তখন হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা হমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানাই যে, মাত্র হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই আমরা মােটামুটি চালিয়ে নিতে পারবাে।
১৫ আগস্টের পরে দেশের রাজনৈতিক নেপথ্যের নানা বিষয়ে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ১৬ই আগস্ট ডঃ কামাল হােসেন লন্ডন চলে যাওয়ার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দেশের কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আমলার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গােপন ও চাঞ্চল্যকর কাহিনী আমাকে শােনান। তিনি বলেন যে, তাঁর ছােট ভাই, কায়সার রশীদ চৌধুরী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর একান্ত সচিব ছিলেন যখন তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রী পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ঐ সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনেক অপকর্ম ও কুকর্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলাে কায়সার রশীদ চৌধুরীর। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে অনেক কাহিনী শােনান। তিনি তখন দিল্লীস্থ পাকিস্তানী দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন ও আনুগত্য ঘােষণার পূর্বে তাঁকে দাফতরিক কাজে করাচী হয়ে ইসলামাবাদ যেতে হয়েছিল কয়েকবার। তখন পাকিস্তানের গােয়েন্দা বিভাগের লােকজন তাঁর গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতাে। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে দিল্লী থেকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সফর শেষে ফেরার পথে করাচী বিমান বন্দরে তাঁকে গ্রেফতার করারও নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য ইসলামাবাদ থেকে তদুদ্দেশে প্রেরিত টেলেক্স বার্তাটি করাচীস্থ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযােগ্য না হওয়ায় তিনি সেবার ভাগ্যক্রমে রেহাই পান। অতঃপর দিল্লী পৌছেই হমায়ুন রশীদ চৌধুরী পাকিস্তানী পক্ষ পরিত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি তাঁর সমর্থন ও আনুগত্য ঘােষণা করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে আরও জানান যে, ১৯৭১-এ কোলকাতায় খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগের জহিরুল কায়উম, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ও কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান হােসেন আলীসহ কতিপয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জোর গােপন তৎপরতা চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত ও নস্যাৎ করার জন্য।
তিনি আরও লিখেছেন, ১৯৭৫-এ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর রাজধানী লিমায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে ডঃ কামাল হােসেন ও হমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের যথাক্রমে দলপতি ও সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। যে কারণে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিউইয়র্ক ও লিমায় হােটেলও রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর খন্দকার মােশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করায় তাঁর লিমা সম্মেলনে যােগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস যে, খন্দকার মােশতাক আহমদ তাঁকে কোন অবস্থাতেই লিমা সম্মেলনে যেতে দেবেন না। কিন্তু তখন স্বল্প সময়ের মধ্যে নিউইয়র্ক ও লিমা হােটেলসমূহে তার পূর্ব নির্ধারিত রিজার্ভেশন বাতিল করা সহজ হবে যদি তিনি লন্ডন যান। সেই মােতাবেক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৮ই আগস্ট তারিখে সপত্নীক লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮ই আগস্ট সােমবার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরেন দুপুর বারােটার দিকে। তিনি আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার সময় আমাদেরকে কার্লসরুয়ে শহরে পৌছেই যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেসম্পর্কে আমাকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। এর এক ফাঁকে তাঁর সাহায্য ও সহানুভূতির প্রতীকস্বরূপ তিনি হাসিনাকে এক হাজার জার্মান মুদ্রা প্রদান করেন এবং ভবিষ্যতেও আমাদের তাঁর সাধ্যমত টাকাপয়সাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। অতঃপর কাসরুয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার মুহূর্তে ঘরের বাইরে এসে দেখি যে, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তাঁর সরকারী রাষ্ট্রদূতের গাড়ীটি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আমাকে এও বলেন যে, কার্লসরুয়ে আমাদের জরুরী কাজগুলাে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন ঐ গাড়ীটিকে সেখানে রেখে দেই। তাঁর এই সহমর্মিতা ও মহানুভবতায় আমি আবেগে এত অভিভূত হয়ে যাই যে, তখন আমার দু’চোখ অশ্রুতে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেয়ার অন্য কোন ভাষা খুঁজে না পেয়ে আমি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
জার্মানি থেকে ভারত গিয়ে পৌঁছানোর নাটকীয়তা বর্ণনা করে ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, ২২শে আগস্ট বন থেকে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে ফোন করে ওদের (ভারতীয় দূতাবাসের) কেউ আমার সঙ্গে কার্লসরুয়েতে যােগাযােগ করেছেন কি না সেসম্পর্কে জেনে নেন। ২৩শে আগস্ট সকালে বনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোনে জানান যে, সেদিনই তার অফিসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি কার্লসরুয়েতে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিকেল ২টার দিকে ঐ কর্মকর্তা ঐ গেস্ট হাউসে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি আমাকে এও জানান যে, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আমাদেরকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে নিয়ে যাবেন। এদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঐ ভদ্রলােক উক্ত গেস্ট হাউসে পৌছান। অতঃপর মালপত্রসহ দুটো ট্যাক্সিতে আমরা কার্লসরুয়ে রেলওয়ে স্টেশনে যাই ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে যাওয়ার জন্য। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমি শহীদ হােসেনকেও সঙ্গে নেই। বিমান বন্দরের বহির্গমন হলে প্রবেশ করার মুহূর্তে শহীদ হােসেনের নিকট হতে বিদায় নেয়ার সময় তাকে শুধু আকার-ইঙ্গিতে জানাই যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। উল্লেখ্য, ভারতীয় ঐ কর্মকর্তা আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উক্ত ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গােপন রাখার জন্য। শহীদ হােসেনও তখন মুখে কিছু বললাে না। সে আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলাে। তখন আমাদের জন্য সহমর্মিতা ও সমবেদনায় তাঁর দু’চোখ ছিল অশ্রুতে ভরা।
ভারতে গিয়ে পৌঁছানো ও সেখানকার অভিজ্ঞতা বিষয়ে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি জাম্বাে বিমানে (পশ্চিম) দিল্লীস্থ পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করি ২৫শে আগস্ট সকাল সাড়ে আটটার দিকে। ‘আগমন হলে কাউকেও দেখলাম না আমাদের খোঁজ করতে। দেখতে দেখতে ঐ বিমানে আগত প্রায় সব যাত্রীই চলে যান। মেরামত ও নবরূপায়ণ কাজের জন্য উক্ত হলটির শীতলীকরণ সিস্টেম বন্ধ ছিল। নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা এবং আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে তখন আমার শরীর থেকে অঝােরে ঘাম করছিলাে। যাহােক, সেখানের এক কর্মকর্তার অফিস থেকে ফোনে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করলাম প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ধরে, কিন্তু কাউকে পেলাম না। ফলে, আমার দুশ্চিন্তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় উক্ত অফিস থেকে হল ঘরে এসে হাসিনাদের সেখানে দেখতে না পেয়ে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। যাহােক, এর একটু পরেই একজন শিখ কর্মকর্তা পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমি উক্ত দুই মহিলার সহযাত্রী কি না। আমি তাদের সফরসঙ্গী জেনে শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঐ যুবতী মহিলাদ্বয়কে ঐ দুই বাচ্চাসহ ভিআইপি হিসেবে এই বিমান বন্দর হয়ে যেতে দেখেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, আজকে তাঁদের কি নিদারুণ করুণ অবস্থা। এটা একেবারেই একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য।”
তিনি আরও লিখেছেন, প্রায় আধঘন্টা পর ঐ শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে জানান যে, কতিপয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতি শিগগির সেখানে পৌঁছবেন আমাদের ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। এরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর দুইজন কর্মকর্তা এলেন আমাদের খােঁজে। তাদের একজন নিজেকে ভারত সরকারের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব বলে পরিচয় দিলেন। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। অতঃপর ঐ দুই কর্মকর্তা আমাদেরকে দুটো ট্যাক্সিতে বিমান বন্দর থেকে নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলােনীর একটি বাসায় নিয়ে যান। তখন ভারতীয় সময় দুপুর ১টা। সুদীর্ঘ চার ঘন্টা বিমান বন্দরে অপেক্ষা, দিল্লীর প্রচণ্ড আবহাওয়া, পারিবারিক শােক, নিজেদের নিরাপত্তা এবং নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় আমি তখন শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে দারুণভাবে বিপর্যস্ত।
ভারতে বসবাসের শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ডিফেন্স কলােনীর বাড়ীটির নীচতলায় ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুম এবং প্রত্যেকটি সংযুক্ত বাথরুমসহ দুটো শয়নকক্ষ। এর ছাদে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি শয়নকক্ষ যা তখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। দুপুরের খাবার ও বিকেলের চা-নাস্তা খাওয়ার পর ঐ দুই কর্মকর্তা চলে যান। ঐ বাড়ীর জানালায় কোন গ্রীল ছিলাে না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই রাতে রেহানাসহ সবাই মিলে একই শয়নকক্ষে থাকার। পরদিন অর্থাৎ ২৬শে আগস্ট উক্ত কর্মকর্তাদ্বয় ঐ বাসায় আসেন আমাদের খবরাখবর জানার জন্যে। তারা আমাকে পরামর্শ দেন সবকিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখপূর্বক জার্মানির আমার ঐ স্কলারশিপটি কয়েক মাসের জন্য সংরক্ষিত রাখার অনুরােধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে। অতঃপর ২৭শে আগস্ট তারিখে আমি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ঐমর্মে পত্র পাঠাই।
১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পরে সেসময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত বিষয়ে ওয়াজেদ মিয়া তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত ঐ কর্মকর্তাকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষপ্রাপ্ত তথ্য জানাতে বলেন। তখন উক্ত কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত মনে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই সংবাদে হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধী তখন হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় বলেন, ‘তুমি যা হারিয়েছে, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তােমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তােমার ছেলেকেই তােমার আব্বা এবং মেয়েকে তােমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তােমার ছােট বােন ও তােমার স্বামী রয়েছে তােমার সঙ্গে। এখন তােমার ছেলে-মেয়ে ও বােনকে মানুষ করার ভার তােমাকেই নিতে হবে। অতএব এখন তােমার কোন অবস্থাতেই ভেঙে পড়লে চলবে না।’
এরপরে অনেক ঘটনা গড়িয়ে বহুবছর পার হয়, পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া দিল্লীস্থ ইন্ডিয়ান এটমিক এনার্জি কমিশনে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এরপরে দেশে ফিরে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনে যোগ দিয়ে সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে ১৯৯৯ সালে অবসরে যান।