চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

আদরের খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু

পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে জাতির ত্রাতা হিসেবে এসেছিলেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মের পর থেকে পিতা-মাতার ডাক নাম আদরের খোকা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন শেখ সাহেব, পরে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা, সময়ের পরম্পরায় নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয় হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে ভুষিত হন বঙ্গবন্ধু হিসেবে।

দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চরম নির্যাতন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ তখন চরমে। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চলে বিভিন্ন কর্মসূচি। পূর্ব পাকিস্তানে কথিত স্বাধীনতার নামে নতুন পরাধীনতা-শোষণের মুখে বাংলা, বাংলার মানুষ। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দিশেহারা।

Bkash July

এরই মধ্যে ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে স্পষ্ট হয়ে উঠে অরক্ষিত বাংলার চিত্র। বিশ্ব দরবারের নজর কাড়তে বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা সভায় যোগ দিতে পাকিস্তানে যান শেখ মুজিবুর রহমান। লাহোরেই তিনি ঘোষণা করেন বাংলার অঘোষিত স্বাধীনতার সনদ ৬ দফা। ৬ দফা ঘোষণার পরপরেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। নড়ে চড়ে বসে আইয়ুব খানের স্বৈরচারি শাসন ব্যবস্থা।

স্বাধিকার আন্দোলন দমাতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের নামে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৬ সালে ৮ মে গভীর রাতে ৬ দফা কর্মসূচি দেয়ার অভিযোগে দেশরক্ষা আইনে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর উত্তাল হয়ে উঠে বাংলা। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পেশ করা হয় ১১দফা। শুরু হয় গণঅভ্যূত্থান। সেই আন্দোলনে শহীদ হন আসাদ, মতিউর, মকবুল, ক্যান্টনমেন্টে রুস্তম ও সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা।

Reneta June

বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৬০’র দশকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রস্তাব থেকে শুরু করে ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং এরপরে ৭০-এর নির্বাচন-এসব রাজনৈতিক পরিক্রমার ভেতর দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা।

ওই সময়ে মাত্র পাঁচ বছরে রাজনৈতিক দৃশ্যপট ব্যাপকভাবে বদলে যায়। তখনকার সময় আরও সুপরিচিত রাজনীতিবিদরা থাকলেও তাদের ছাপিয়ে সামনের কাতারে চলে আসেন শেখ মুজিব। এদিকে ১৯৬২ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুর পর বেশ দ্রুত মাত্র আট বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন এই অঞ্চলের একচ্ছত্র রাজনৈতিক নেতা।

ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দফা দাবি উত্থাপন শেখ মুজিবকে একবারে সামনের কাতারে নিয়ে আসে। ৬ দফার মূল বিষয় ছিল পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করা, যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে। ৬ দফার মাধ্যমে শেখ মুজিব গ্রাম এবং শহরের মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি। এর কয়েক মাস পরেই মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। অভিযোগ ছিল তিনি ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। সেই থেকে প্রায় তিনবছর কারাগারেই কেটেছে শেখ মুজিবের। কারাগারে থাকা শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এ সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালিন ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ মিলে গঠন করা হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সেখানে তুলে ধরা হয় ১১ দফা দাবি, যার মধ্যে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ৬ দফা দফা দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন থেকেই শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিও প্রাধান্য পায়। ৩৩ মাস পর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি মেলে শেখ মুজিবের।

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়ার। দিন ঠিক করা হয় ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। স্থান তখনকার রেসকোর্স ময়দান। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ সেদিনই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।

ওই সময়ের বন্দির দিনগুলো ডায়েরির খাতায় লিপিবদ্ধ থাকায় স্থান পেয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে। বিশেষত তার গ্রেফতারের পর তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পত্র-পত্রিকার অবস্থা, শাসকদের নির্যাতন, ৬ দফা বাদ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবার শাসকদের চেষ্টা ইত্যাদি বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন।

আজীবন মানুষের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন। বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বার বার তার ৬ দফা কেন্দ্রিক লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধাপে ধাপে মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত ও উজ্জীবিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৬ দফা ছিল মুক্তির সনদ, সংগ্রামের পথ বেয়ে যা এক দফায় পরিণত হয়েছিল, সেই এক দফা স্বাধীনতা। সেসময় অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিকল্পনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।

সামরিক শাসকগোষ্ঠী হয়তো কিছুটা ধারণা করেছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। ৬ দফাকে বাদ দিয়ে কয়েকটি ধারার দল জোট বেঁধে ৮ দফা দাবিসহ আন্দোলন ভিন্নখাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, সে কাহিনিও রোজনামচায় পাওয়া যায়। একেবারেই বিনা বিচারেই শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন একাকী একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল তিনি বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বার বার বলেছেন। তার শরীর মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যেত। বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে উন্নত জীবন প্রদানের স্বপ্ন ছিল তার। আন্দোলন ও হরতালকে কেন্দ্র করে কারাগারে ধরে আনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। দলের প্রতিটি সদস্যকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন, তাদের কল্যাণে কত চিন্তিত থাকতেন সেকথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে কারাগারের রোজনামচায়।

শোষিত ও বঞ্চিত জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে যে নেতা মৃত্যুকে বারবার তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন, তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে আপন করে নিয়েছিলো বাঙালি জাতি। সেদিনের সমাবেশে উপস্থিত লাখো জনতা দুই হাত তুলে তোফায়েল আহমেদের সেই প্রস্তাব সমর্থন করেন। সেই থেকে জাতির জনক শেখ মুজিবের নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি।

ছাত্রজীবন থেকেই মাটি আর মানুষের জন্য নিবেদিত ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার দুরন্ত কিশোর খোকা। কর্মজীবী বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও গৃহিনী মা সায়েরা খাতুনের আদরের এই সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন কোটি বাঙালির প্রিয় মুজিব ভাই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হকসহ বরেণ্য সব নেতাদের সান্নিধ্যে শেখ মুজিব ছাত্র নেতা থেকে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ।

প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে আওয়ামী লীগ, দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়েন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বপন করেন বাঙালীর মুক্তির স্বপ্নবীজ। যার সমগ্র জীবন কেটেছে লড়াই-সংগ্রামে। বাঙালির শোষণ মুক্তির এই স্বপ্নদ্রষ্টা অধিকার, আর দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়ে শাসকদের রোষানলে পড়েছেন, কারাগারেই কাটিয়েছেন প্রায় ১৪ বছর। দীর্ঘ এই সংগ্রামী জীবনে ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ যেমন আছে তেমনি আছে ইতিহাসখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মত ঘটনাও। যে মামলায় কারাগারে নেয়া হয়েছিলো শেখ মুজিবকে। প্রতিবাদে ন্যায় আর ন্যায্যতার পক্ষে গর্জে ওঠেছিলো পুরো বাংলা।

শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শ্রমিক, কৃষক, সর্বস্তরের জনতা মে এসেছিলো রাজপথে। শেষ পর্যন্ত তার মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

পাকিস্তানি জান্তার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পান বাঙালির আবেগ, আকাঙ্খা আর মুক্তির সংগ্রামকে এক সুতোয় গাঁথা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবকে দেয়া এই উপাধি একসময় তার মূল নামকে ছাড়িয়ে যায়। হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ভাবে নানান ঐতিহাসিক দলিলেও নামের সাথে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় উপাধিটি। আর তাইতো এখনো জ্বালাময়ী স্লোগানে সমস্বরে উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ISCREEN
BSH
Bellow Post-Green View