দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীদলগুলোর হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের আকাশপথেও। টানা অবরোধে দেশের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফ্লাইটে যাত্রী কমেছে। তবে কোনো ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি, বাতিলও হয়নি কোনো ফ্লাইট।
নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পর্যটনের ভরা মৌসুম। কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকে ঠাসা ভিড় লেগেই থাকে। তবে এবারের মৌসুমে পর্যটন কেন্দ্রিক ভিড়গুলো নেই বললেই চলে।
রাজধানীর সেগুন বাগিচার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী পরশ আহমেদ। প্রায় প্রতিবছরই নভেম্বর ডিসেম্বরে পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকার বাইরে পর্যটন কেন্দ্র ছুটি কাটাতে যান। তবে এই বছর তিনি যাবেন কিনা, এখনো সন্ধিহান।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে পরশ আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সারাবছরই কর্মব্যস্ত থাকি, নভেম্বর ডিসেম্বর সন্তানদের পরীক্ষা শেষ হলে একটু ছুটি কাটাতে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া হয়। কিন্তু এবার রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বোধহয় কোথাও যাওয়া হবে না। নিজেদের নিরাপদ থাকাটা সবচেয়ে বেশি দরকার। পরিস্থিতি ভালো হলে আগামী বছর ভ্রমণ করব।
ডিসেম্বরের ৭ তারিখে পরিবার পরিজনসহ রংপুরে ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য আকাশ পথে এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বুকিং দিয়েছেন ব্যবসায়ী ফরহাদ খান। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে জানালেন রংপুর ধাপে তাদের পৈত্রিক নিবাস। সন্তানদের স্কুল ছুটির কারণেই নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটাতে যাচ্ছেন। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
ফরহাদ বললেন ‘সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রংপুর শহর কমপক্ষে ৪০ কিলোমিটার। উড়োজাহাড়ে সৈয়দপুর গেলেও সেখান থেকে যদি বাস বা গাড়ি কিছু না পাওয়া যায়, এই বিষয়টা বেশি ভাবাচ্ছে, পাশাপাশি যেভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বাসে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, সেটাও আশঙ্কাজনক। এই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ি বের করাও নিরাপদ নয়।’
‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা যদি বেশি খারাপ থাকে তাহলে টিকিট বাতিল করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। কারণ নিজেদের নিরাপত্তাটা প্রথম’-বলেন ফরহাদ।
দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করা এয়ারলাইন্সগুলোর দাবি, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর টানা অবরোধের কারণে আকাশপথে প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ২০ শতাংশ যাত্রী কমেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে যাত্রী সংখ্যা আরও কমবে। অথচ নভেম্বরের শুরু থেকে মার্চ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রীর চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত কোনো ফ্লাইটই ফাঁকা যায় না। এতে এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এ বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোর, রাজশাহী, বরিশাল রুটে শতাধিক ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকে ভ্রমণের তারিখ বদল করছেন। অনেক সময় এক ফ্লাইটের টিকিট কাটা যাত্রী আরেক ফ্লাইটে পাঠানোর প্রস্তাবে রাজি হচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে অনেককে তার টিকিট রিফান্ড দিতে হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোর।পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এয়ারলাইন্সগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যা বলছে বিমান বাংলাদেশ
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব রুটের (কানাডা ও যুক্তরাজ্য ছাড়া) টিকিটে ১০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এরপরও পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রুটে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বিমান সূত্র।
বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে বেসরকারি এয়ারলাইন্সের মতো বিমানেরও যাত্রী কমছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। তাই আর এক-দুই সপ্তাহ দেখে হয়তো ফ্লাইটের সংখ্যা কমাতে হবে।’
যা বলছে ইউএস বাংলা
দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলা বলছে, অবরোধে তাদের যাত্রীসংখ্যা কমেছে ১৫ থেকে ২০ ভাগ। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস দেশের ভেতরে সাত রুটে প্রতিদিন ৭০টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
এয়ারলাইনসটির জনসংযোগ ও বিপণন বিভাগের মহাপরিচালক কামরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সাধারণত বছরের এই সময়টা পর্যটনের সময়। কিন্তু এই বছর অবরোধ ও হরতালের কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ কোথাও যাচ্ছেন না। সাধারণ সময়ে তাদের যাত্রীর সংখ্যা থাকে সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। কিন্তু এখন ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কক্সবাজার ও সিলেটের মতো পর্যটন স্থানগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য রুটের তুলনায় কম।
তিনি বলেন, আমরা কোনো রুটেই ফ্লাইট কমাইনি। তবে সামগ্রিকভাবে আমাদের লোড ফ্যাক্টর ১৫ থেকে ২০ ভাগের মতো কমেছে। এয়ারপোর্ট টু এয়ারপোর্ট ট্রাভেল করা যাচ্ছে, কিন্তু ঘর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসা বা এয়ারপোর্ট থেকে গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাত্রীদের মধ্যে শঙ্কা আছে।
যা বলছে নভো এয়ার
দেশের আরেক বেসরকারি এয়ারলাইন্স নভোএয়ারের বাজারজাতকরণ ও বিপণন বিভাগের প্রধান মেসবাহ উল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অবরোধের প্রভাবে আমাদের যাত্রী অনেক কমেছে। পর্যটন মৌসুম হলেও আমাদের অন্তত ২০-২৫ ভাগ যাত্রী কমেছে। করোনাকালীন সময়ে ২০২০, ২০২১ সালে আমরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এরপর ২০২২ সালে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে ফুয়েলের দাম বাড়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এখন হরতাল অবরোধ রাজনৈতিক সহিংসতায় বড় ধাক্কা লাগছে।
যা বলছে এয়ার অ্যাস্ট্রা
দেশের নতুন একটি বেসরকারি এয়ারলাইনস হচ্ছে এয়ার অ্যাসট্রা। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ১৫ দিনে তাদের যাত্রীসংখ্যা কমেছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। ভরা মৌসুমেও পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যাত্রীদের চাপ নেই।
প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের উপব্যবস্থাপক সাকিব হাসান শুভ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, গত দুই সপ্তাহে আমাদের যাত্রী কমেছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। যেমন অন্যান্য বছর কক্সবাজার রুটে এই সময়ে টিকিট পাওয়াই দায় হতো, সেখানে এবার যাত্রী নেই বললেই চলে। যাত্রীর অভাবে আমাদের কিছু ফ্লাইট অ্যাডজাস্ট করতে হচ্ছে। এই সময়ে যাত্রীর যে স্বাভাবিক ফ্লো থাকে, সেটি অনুপস্থিত।
যা বলছে আটাব
দেশে ট্রাভেল এজেন্টদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) বলছে হরতাল অবরোধের কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা।
সংগঠনটির মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রধানত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম। অধিকাংশরাই পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ঘুরতে যায়। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল অবরোধের কারণে সেটা হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইটে আমাদের ৪০ শতাংশ টিকিট বিক্রি কমে গেছে। দেশের বাইরে ভ্রমণকারীদের টিকিট বুকিং ৫০ শতাংশ কমেছে। এটা বড় একটি ধাক্কা, রাজনৈতিক সহিংসতায় আর্থিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে আকাশপথ সহ প্রতিটি সেক্টরে। তবে রাজনৈতিক সংকট সমাধান না হলে অবস্থা আরও শোচনীয় হবে বলে মনে করছেন এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা।