টি-টুয়েন্টি, টি-টেন দ্য হান্ড্রেডের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আগ্রাসনে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেই শঙ্কা জেগেছিল । আর সেই শঙ্কায় ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিয়েছে সাউথ আফ্রিকা। প্রথম সারির খেলোয়াড়রা নিজ দেশে টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলতে আগ্রহী। তাই নিউজিল্যান্ড সফরের দুই টেস্টের সিরিজের জন্য আনকোরা দল দিয়েছে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা।
১৪ সদস্যের প্রোটিয়া দলের ৭ জনেরই টেস্ট অভিষেকই হয়নি। ২৭ বর্ষী নেইল ব্যান্ডকে করা হয়েছে অধিনায়ক, যিনি টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন। দ্বিতীয় সারির স্কোয়াড গঠনের বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে চলছে ব্যাপক আলোচনা। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) প্রধান নির্বাহী নিক হকলিও তাতে শামিল হলেন।
হকলির মতে, সাউথ আফ্রিকার একেবারেই দুর্বল দল নিউজিল্যান্ডে পাঠানোর মতো পরিস্থিতিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক দিলেন। একইসঙ্গে জানালেন, টেস্ট ক্রিকেটে দ্বৈত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ভারতের বাইরের দেশগুলো টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও তাদের সামনে আর্থিক সংকট এসেছে।
‘চ্যালেঞ্জটা আসলে অর্থনৈতিক। বিশ্বের এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে টি-টুয়েন্টি, ওয়ানডে এবং টেস্ট থেকে সমান আয় হয়। তবে একটি টেস্ট খেলার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।’
‘আমরা অস্ট্রেলিয়ায় গত কয়েক বছরে ও চলতি গ্রীষ্মে আমরা যা দেখছি, গ্রীষ্মে যুক্তরাজ্যে যা দেখেছি তা হল, টেস্ট ক্রিকেট সত্যিই কিছু দেশে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সেই অর্থে, এটি দ্বৈত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যারা টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষেত্রে একটু বেশি সংগ্রাম করছে, আমরা তাদের সমর্থন করাটাই চ্যালেঞ্জ।’
ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট এসএ-২০ লিগের উত্থানের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভব করেছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে গত মৌসুমে অজিদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সুপার লিগের অন্তর্ভুক্ত সিরিজটি বাতিল করেছিল সাউথ আফ্রিকা। তবে নিউজিল্যান্ডে দুর্বল টেস্ট দল গঠন করে প্রোটিয়াদের দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিতর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। যদিও ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা জোর দিয়ে বলেছে, তারা টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে বিষয়টি সাংঘর্ষিক পর্যায়ে না যায়, তা নিশ্চিতে কাজ করছে।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ভারতের মতো বড় তিনটি দেশকে ছাড়িয়ে টেস্টকে প্রাণবন্ত রাখার একটি উপায়ও জানালেন হকলি। জানালেন, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত সব সিরিজের জন্য ন্যূনতম তিনটি ম্যাচ হওয়ার জন্য চাপ দেবে।
‘অগ্রাধিকার হল ন্যূনতম তিন টেস্টের সিরিজ। আমরা এটার পক্ষে ওকালতি চালিয়ে যাব। আমি মনে করি সামনের এফটিপি (ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম) নিয়ে কাজ করতে হবে। আসলেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ন্যূনতম তিন ম্যাচ সিরিজ দাবি করে। তারপর আমরা যতটা সম্ভব সর্বোত্তমভাবে নিশ্চিত করতে পারি যেন ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি প্রতিযোগিতাগুলোর প্রতি পাশ কাটাতে পারি। এটি রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্স, যাতে প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক , বিশেষত টেস্টকে অগ্রাধিকার দেয়।’
বর্তমান টি-টুয়েন্টির যুগে আর্থিক লাভের আশায় সবার সেদিকে ঝুঁকে পড়ার বাস্তবতা এড়ানো যাবে না, সেটিও উপলব্ধি করছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী। সমন্বয়ের মাধ্যমে টেস্ট ও টি-টুয়েন্টি সূচি ঠিক রেখে একসাথে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলেই তিনি মত দেন।
‘নতুন বাচ্চাদের এবং মানুষদের খেলায় আনার ক্ষেত্রে টি-টুয়েন্টির ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। আমি মনে করি এটা খুব স্পষ্ট যে অস্ট্রেলিয়ায় পুরো সময়জুড়ে বিগ ব্যাশ ছিল। এর মাঝেই সবসময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। অবশ্যই আমরা আইসিসির সাথে সময়সূচি নিয়ে গ্রুপের মাধ্যমে কাজ করব। নিশ্চিত করতে হবে যে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি না করে প্রকৃতপক্ষেই মানুষের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।’
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনিং ব্যাটার উসমান খাজা বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং ব্যাটার ‘আমার ব্যক্তিগত মত, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমস্যা হল যে অন্যকিছু দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য তেমন পারিশ্রমিকও পাচ্ছে না। এটাই মূল ঘটনা। বিষয়টা জানি, কারণ অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলেছি। প্রশ্ন করেছি, তাদের গড় বেতন, তাদের দেশের হয়ে খেলার জন্য চুক্তি অনুযায়ী চুক্তি ফি কত।’
‘সব বোর্ডের আর্থিক অবস্থা কেমন, তা খুব ভালোভাবে দেখতে হবে। তারা কেমন সংগ্রাম করছে, টাকা সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা, খেলোয়াড়রা পাচ্ছে কিনা দেখতে হবে। তাদের জন্য আমাদের একটা উপায় বের করতে হবে। অন্য দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য উৎসাহিত করা লাগবে। এজন্য বিশ্বের সব ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে খেলোয়াড়দের সর্বোত্তম উপায়ে কীভাবে অর্থ প্রদান করা যায়, তা নির্ধারণে চেষ্টার জন্য স্বচ্ছতা প্রয়োজন।’
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহ আইসিসি এবং বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল না হওয়ার অভিযোগ আনেন। তার ভাষ্য,
‘অবশ্যই তারা বিষয়টি পাত্তা দেয় না। সমস্যাটা কী, এটা বেশ স্পষ্ট। আইসিসি বা কেউ শীগগিরই পদক্ষেপ না নিলে টেস্ট ক্রিকেট সত্যিকার অর্থেই আর টেস্ট ক্রিকেটে পরিণত হবে না। কারণ সেরা খেলোয়াড়দের বিপক্ষে নিজেকে যাচাই করছেন না।’
‘বুঝতে পারছি কেন খেলোয়াড়রা আসে না। তারা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কেনো আইসিসি বা শীর্ষ দেশ যারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে, তাদের শুধু টেস্ট ম্যাচের জন্য নির্ধারিত ফি নেই। এমন করলে সবাই টেস্ট খেলতে উৎসাহিত হয়। অন্যথায় তারা শুধু টি-১০ বা টি-টুয়েন্টি খেলে।’