স্বাধীনতা পর থেকে ৯০ এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাস্কর্য শিল্প এবং তার নান্দনিক-সৃজনশীল চর্চা নিয়ে তেমন একটা বিতর্ক ছিল না বললেই চলে। এ সময়টাতে ভাস্কর্য শিল্প উত্তর উত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ২০০০ সালের পর এসে দৃশ্যপট কিছুটা বদলাতে শুরু করে। ভাঙা এবং অপসারণ হয় বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য। এর পেছনে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের ভূমিকা রয়েছে।
শুরু থেকে যদি বলা যায়-২০০৮ সালে বিমান বন্দর চত্বরে লালন ভাস্কর্য ‘অপসারণের’ কথাটি বলা যায়। আর সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য ‘গুম’ হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে পুনঃস্থাপনের কথাটি বলা যায়। এর মাঝে আরও কিছু ঘটনা ছিলো বহুল চর্চিত এবং আলোচিত। যা জাতীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়। এমন কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে..
বিমানবন্দর চত্বরে লালন ভাস্কর্য
বিদেশীদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখে তৈরি করা হচ্ছিলো লালন ভাস্কর্য। সেখানে একতারা বা দোতারা হাতে পাঁচজন বাউলের প্রতিকৃতি রাখার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু স্খানীয় একটি মাদ্রাসার ছাত্র, খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির মুফতি নূর হোসেন নূরানী ও মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি নামের সংগঠনের হুমকি ও চাপের মুখে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় এটি ভেঙে ফেলে। যা তখন সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি করে।
এই ভাস্কর্যটি নির্মাণের অনুমোদন দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অর্থায়ন করে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। নির্মাণ করছিলেন শিল্পী মৃণাল হক।
ভাস্কর্যটি ভাঙার জন্য খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির ও মূর্তি প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মুফতি নূর হোসাইনের নেতৃত্বে বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখের গোলচত্বর এলাকায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবরের মধ্যে ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বিমানবন্দর থানা কর্মকর্তাদের উপস্খিতিতে ভেঙে ফেলা হয় ভাস্কর্যগুলো।
‘বলাকা’ ভাস্কর্যে হামলা, ভাংচুর
একই বছর ২০০৮ সালে নভেম্বরে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় বিমান অফিসের সামনে স্থাপিত ‘বলাকা’ ভাস্কর্য রাতে ভাংচুর করে আল বাইয়িন্যাত নামে ধর্মভিত্তিক একটি সংগঠনের কর্মীরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ভাস্কর্যটিতে হামলা করে ভাস্কর্যের নিচের অংশ ভেঙ্গে দেয়া হয়। পুলিশ ও র্যাবের বাধায় প্রায় আধঘণ্টা পর হামলাকারীরা ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় জানা যায়: প্রায় শ’খানেক লোক রাত সাড়ে ৯টার দিকে বলাকা ভাস্কর্যের ওপর চড়াও হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাস্কর্যের বকের প্রতিকৃতির ওপরে উঠে এর ডানা ভাংচুর করে। অন্যরা বকের পায়ে রশি বেঁধে টানছিল!
মতিঝিল এলাকায় ১৯৮৯ সালে ৪১ ফুট উচ্চতার বলাকা ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। এর স্থপতি মৃনাল হক ভাংচুরের নিন্দা করে তখন বলেছিলেন: শিল্প সংস্কৃতির ওপর একের পর এক আঘাত আসছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে চুপচাপ। সংস্কৃতিকর্মীসহ দেশের সব মানুষকে এখন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে তৈরি ভাস্কর্য
২০১৬ সালের শেষ দিকে গ্রীক দেবী থেমিসের আদলে গড়া ন্যায়বিচারের প্রতীক এই ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বসানো হয়েছিল। ভাস্কর্যটি অপসারণের জন্য হেফাজতে ইসলাম দাবি জানিয়ে আসছিল। ভাস্কর্যটির অপসারণ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী, সংস্কৃতি কর্মী এবং বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা রাস্তায় নেমে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে বিক্ষোভ করেন। ভাস্কর্যটির শিল্পমান নিয়েও বিতর্ক ছিলো।
হেফাজতে ইসলামের সমর্থকরা ঢাকায় বিক্ষোভ করে এবং রোজা শুরুর আগে এটি সরিয়ে নিতে সময় বেঁধে দেয় সরকারকে।
সংগঠনটির আমির আহমদ শফি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যে আঘাত করা হয়েছে’।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
এই প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের মে মাসে ভাস্কর্যটি সরানো হলে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পরে ভাস্কর্যটি হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও মিছিল করার চেষ্টা করে প্রতিবাদকারী কিছু মানুষ। তবে পুলিশ জল কামান ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
২০২০ সালে নভেম্বরে রাজধানীর ধোলাইখাল মোড়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অংশ হিসেবে সরকার বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ শুরু করে। এ ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইসলামে জীবন্ত চলনক্ষম জীবের ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি তৈরি হল মূর্তি বা প্রতিমা তৈরির সমতুল্য, যা পরবর্তীকালে ঐ ভাস্কর্যের উপাসনার দিকে ধাবিত করে, একারণে ইসলামে এর প্রতি কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিনিধিগণ উক্ত মতের বিরোধিতা করে বলেন, ভাস্কর্য আর উপাসনার মূর্তি এক নয়, হেফাজতে ইসলাম সরকার বিরোধীদের প্ররোচনায় ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে রাজনৈতিক অসুবিধায় ফেলতে চাইছে।
তখন ইসলামপন্থী অধিকাংশ দল সরকারের বিরোধিতা করলেও কিছু ইসলামপন্থী দল সরকারের পক্ষ হয়ে কথা বলেন। উদ্ভুত পরিস্থিতির এক পর্যায়ে ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম হেফাজত নেতা মামুনুল হক, সৈয়দ ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদোহী মামলা দায়ের করে।
যদিও পরে সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
ওই বছর কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মানাধীন একটি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশ বিশেষ ভাঙা হয়। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে এবং জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য
চলতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সেন্সরশিপ ও নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে ঢাবির চারুকলা অনুষদের কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটির মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ করা ও হাতে রাখা গীতাঞ্জলিতে পেরেক বিদ্ধ দেখানো হয়।
বৃহস্পতিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেখা যায় ভাস্কর্যটি নেই! আবার দুপুরের দিকে ওই জায়গায় লিখে দেওয়া হয়েছে, ‘গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!’
তাৎক্ষণিকভাবে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কেউ দায় স্বীকার না করলেও পরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দু’দিন পর রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি খণ্ড খণ্ড আকারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে উদ্ধার করে একই স্থানে আবারও শিক্ষার্থীরা স্থাপন করে। নতুন করে স্থাপিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কের্য’র পাশে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নতুন করে দু’টি ব্যানার টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে: ‘ডিডিজটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং সব ধরনের সেন্সরশিপ বন্ধ কর’ এবং ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি’।
এ ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রগতিশীলদের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়।