সদ্য সমাপ্ত দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ‘চিলড্রেন অব হেভেন’ খ্যাত ইরানের বিখ্যাত নির্মাতা মাজিদ মাজিদি। যিনি কালার অব প্যারাডাইস, বারান, সং অব স্প্যারো, দ্য ফাদার কিংবা দ্য উইলো ট্রির মতো ছবি বানিয়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বলা হয় কিয়ারোস্তামি পরবর্তী ইরানি ছবির সাইনবোর্ড মাজিদি!
রবিবার (২৮ জানুয়ারি) চ্যানেল আইকে দেওয়া একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি তার সিনেমা নিয়ে কথা বলেন, সেই সঙ্গে প্রথমবার বাংলাদেশে আসার অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন-
আপনি কি মনে করেন চলচ্চিত্র সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে?
ঠিকই বলেছেন একটা ভালো ফিল্ম ভালো সমাজ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু চলচ্চিত্র নয়, একটি ভালো বই এবং একটি ভালো গল্পও ভালো সমাজ তৈরি করে। শিল্পীরা শিল্পের মাধ্যমে একটি দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। দেশকে বিশ্বের দরবারে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিলো ?
সিনেমায় আমার যে গল্পটা থাকে, সেই গল্প আমি সাবলীলভাবে সবার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করি। তবে গল্পের ঘটনা থাকে গভীর। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার যে চিত্র, সেখান থেকে আমি গল্পটা তুলে আনার চেষ্টা করি। আমি চাই সাধারণ মানুষের গল্পগুলো সবার কাছে ফুটে উঠুক।
আপনার চলচ্চিত্রগুলোতে শিশুরাই থাকে মূল চরিত্রে। তাদের চোখ দিয়ে আপনি গল্পটা তুলে ধরেন। সব সময় এমনটাই কেন হয়?
দেখুন, বাচ্চারা হলো নিষ্পাপ। তাদের মধ্যে যে কোমলতার বিষয়টা রয়েছে সেটা মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাদেরকে ঘিরে গল্প হলে সেটা মানুষের মনের খুব গভীরে পৌঁছায়। গল্পটা গ্রহণযোগ্য হয়। আমার চেষ্টা থাকে শিশুদের মাধ্যমে গল্পের যে চিত্রায়ন, তার মধ্যে দিয়ে শিশু ও বড়দের মধ্যে একটা সম্পর্কের সেতু তৈরী করা।
আপনি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরী করেছেন? এই সিনেমাটি নির্মাণের পেছনে আপনার উদ্দেশ্যর কথা যদি বলেন…
মহানবীকে (সা.) নিয়ে আমার এই সিনেমাটি তৈরী করতে ৭ বছর সময় লেগেছিলো। সব কিছু বিশাল আয়োজনে করতে হয়েছে। আপনারা হয়তো জানেন, সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম নিয়ে এক ধরনের অপপ্রচার রয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া। ইসলাম অশান্তির ধর্ম! ইসলামের মধ্যে জঙ্গিবাদ রয়েছে! একটা শ্রেণি রয়েছে যারা ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে আসছে।
কিন্তু ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম, ভালোবাসার ধর্ম। ইসলামে মানুষকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। তিনি সারা বিশ্বের মানুষের জন্য রহমতস্বরুপ। তিনি সারা বিশ্বের জন্য ইসলামকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। সেই ইসলামের প্রকৃত বাণীকে তুলে ধরতেই আমি এই সিনেমা বানিয়েছি। যারা ভুলভাবে ইসলামকে দেখছে, তাদের কাছে এই বার্তাটি আমি পৌঁছে দিতে চাই যে- ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’।
আপনি যখন ফিল্মের সেটে কাজ করেন, তখন পুরো সেটে এক ধরনের নিরবতা কাজ করে, আপনার সাথে যারা কাজ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতাটা এরকম। এমনটা কেন করেন জানতে পারি?
একটি ভালো সিনেমা তৈরী করা মানে হলো সমাজ পরিবর্তনে একটি ভালো কাজ করা। যখন আমি একটা ভালো কাজ করতে যাই, তখন অবশ্যই চাই যেই টিম নিয়ে আমি কাজ করব তাদের মধ্যে যেন শান্তি বিরাজ করে। তাদের মধ্যে যেন সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। যদি আমি নিজেই এই জায়গাটা তৈরী করতে না পারি, তাহলে আমি মানুষকে কীভাবে শান্তির পথ দেখাবো! তাই আমি চাই আমাদের টিমটাই যাতে মডেল হয়। তাহলেই তো আমরা দেশ সমাজের জন্য একটা ভালো কাজ করতে পারব। এটাই আমি চিন্তা করি, আর এভাবেই আমি কাজ করি।
‘বিয়ন্ড দ্য ক্লাউডস’ সিনেমায় বলিউডের দিপীকা পাড়ুকোন স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছিলেন, পরে সিনেমায় সেই চরিত্রে মালবিকা মোহনানকে কাস্ট করা হয়, যিনি একদমই নবাগত ছিলেন। তবে কি বড় আর্টিস্টদের নিয়ে আপনি কাজ করবেন না ?
একটা ফিল্মের জন্য গল্পটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায় সিনেমার গল্পের চাইতে লিড রোলে জনপ্রিয় আর্টিস্টদের কাস্ট করতেই ব্যস্ত থাকে নির্মাতারা। এরপর সেই আর্টিস্ট এর উপরই ফোকাস চলে যায়, যারফলে ছবিতে গল্পের গুরুত্ব কমে যায়। আমি মনে করি গল্পটাই প্রধান। আমার গল্প ভালো হলে তাহলে আমি ভালো চলচ্চিত্র উপহার দিতে পারব। তবে আর্টিস্টের অবশ্যই তার যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। দক্ষতা থাকলে একজন সাধারণ আর্টিস্টকে দিয়েও ভালো কাজ বের করা সম্ভব। তবে এমনটাও বলছি না যে বড় আর্টিস্টদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। অবশ্যই তাদের গুরুত্ব রয়েছে। তবে গল্পটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার চলচ্চিত্রের মিউজিকও গল্পের মতোই শক্তিশালী হয় যেমন ‘মুহাম্মদ’ ও ‘বিয়ন্ড দ্য ক্লাউডস’-এ এ আর রাহমান এর সঙ্গে কাজ করেছেন- এই কাজগুলোর অভিজ্ঞতা যদি আমাদের জানাতেন…
মিউজিক একটা ফিল্মের গুরুত্বপূর্ণ পার্ট। মিউজিককে কোনভাবেই খাটো করে দেখা যাবেনা। যে কারণে আমি মিউজিক তৈরীতে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ‘বিয়ন্ড দ্য ক্লাউডস’ এর কথাই বলি বা মুহাম্মদ সিনেমা, এই দুটি সিনেমায় এ আর রাহমান এর সাথে কাজ করা হয়েছে। সেটি দারুণ অভিজ্ঞতা। এ আর রাহমানের সঙ্গে আমার ভালো একটা বোঝা পড়া তৈরী হয়েছে।
আপনার চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের ছায়া দর্শক দেখতে পায়, এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
একটা ভালো ফিল্ম সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারে, তেমনটাই আমি দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাতে। তার সিনেমার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে তিনি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছিলেন। ভারতের মানুষের কথা – সমাজের কথা তুলে ধরেছিলেন। আমি ভারতকে চিনতে পেরেছি তার চলচ্চিত্রের সাধ্যমে। আর তখন থেকেই ভারত সফর করার আগ্রহ তৈরী হয়েছে আমার। আর এটা সম্ভব হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের জন্যেই।
২২ তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আপনি এলেন, মাস্টারক্লাস নিলেন, পুরো আয়োজনটি আপনার কেমন মনে হলো?
একটি দেশের চলচ্চিত্র উৎসব একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের চলচ্চিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এক্ষেত্রে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এতে করে এদেশের চলচ্চিত্রের মান যেমন উন্নত হবে। তেমনি বিশ্ব সমাজেও আরোও বেশি করে এই দেশ সমাদৃত হবে। আমি মনে করি বাংলাদেশের সরকার এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে। এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে তরুণ নির্মাতারাও চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রেরণা পাবে।