আসাদুজ্জামান বাবুল: হঠাৎই দেশব্যপী আলোচনায় আসা দুবাইয়ের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খান ওরফে সোহাগ মোল্লা ওরফে রবিউল ইসলাম রবি’র বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার আশুতিয়া গ্রামে। সে ওই গ্রামের দিনমজুর মতিয়ার রহমান মোল্লার ছেলে। সে কীভাবে এতো টাকার মালিক হলো, তা নিয়ে তার আত্মীয় থেকে শুরু করে দেশবাসীর মধ্যে রয়েছে প্রশ্ন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৩৫ বছর বয়সী আরাভের বাবা মতিয়ার রহমান মোল্লা একসময় বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলায় ফেরি করে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। ১৯৮৮ সালে এখানেই জন্ম হয় সোহাগ ওরফে আরাভ মোল্লার।
২০০৫ সালে চিতলমারী সদরের একটি বিদ্যালয় থেকে সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ এসএসসি পাশ করেন। এসএসসি পাশ করার পর দারিদ্র্যতার কারণে সে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। ২০০৮ সালে ভাগ্যে বদলাতে চিতলমারী ত্যাগ করে ঢাকায় চলে যান।
তবে কেউ কেউ বলেছেন, তার বাবা জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে বহন করে ফেরি করতেন। সংসারের অভাব দেখে ঢাকায় চলে যায় আরাভ। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আরাভ সকলের বড়।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর আরাভ খান ফেসবুক লাইভে এসে তার কোটিপতি হওয়ার গল্প বলেন। আরাভ বলেন, আমি একজন দিনমজুরের ছেলে। আমি ঢাকায় এসে অনেক কষ্ট করেছি। হোটেলে কাজ করেছি। জীবনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। অনেক কষ্ট হওয়ার পরেও লক্ষমাত্রায় পৌঁছাতে হাল ছাড়ি নাই। মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল বলেই আজ আমি এ অবস্থানে এসেছি। অনেক কষ্ট করে আমি আমার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। এখানে আমার কিছু ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে।তারাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটাচ্ছে। গণমাধ্যমে যেসব খবর আসছে তা পুরোপুরি সত্য নয় বলে উল্লেখ করেন এই আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
নিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার কথা তুলে ধরে আরাভ খান বলেন, আমার নামে মামলা হয়েছে এ কথা সত্য। তবে আমি কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নই। পুলিশ আমাকে অস্ত্র মামলায় জেলে দিয়েছে, এ কথা সত্য। তবে আমি দোষী না। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় জেলে গেছি। আবার জামিনে বেরিয়ে এসেছি। আদালত যদি আমাকে সাজা দেন, তা হলে আমি সে সাজা মাথা পেতে নেব।
দুবাইয়ে আরাভ খানের এই স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের খবর জানাজানি হলে এলাকায় আলোচনায় ঝড় ওঠে। সবার মুখে মুখে একই প্রশ্ন, আরাভ ওরফে সোহাগ মোল্লা কীভাবে রাতারাতি এত টাকার মালিক বনে গেলেন? রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক বনে যাওয়া আরাভের এই রহস্য খুজতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা বিভাগ। মানুষের মুখে মুখে চলছে নানা গুঞ্জন।
আজ রোববার (১৯ শে মার্চ) সরেজমিন কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে গিয়ে সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ খানের চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লার সঙ্গে কথা হয়। সে জানায়, সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ খান এত অল্প সময়ের মধ্যে এত টাকার মালিক হলো কীভাবে, তা আমাদের বুঝে আসে না। বিস্ময় প্রকাশ করে চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লা বলেন, গত কয়েক দিন আগে সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ খান তার দুই বোন ও মা-বাবাকে দুবাই নিয়ে গেছেন।
কথা হয় কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্নার সঙ্গে। তিনি বলেন, সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ খান একই ব্যক্তি। আমার গ্রামেই তার বাড়ি। সে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ৫-৭ সাত বছর হলো সে এলাকায় আসে না। হঠাৎ সে কীভাবে এত টাকার মালিক হলো, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আরাভের উত্থানের গল্প সত্যিই খুব বিস্ময়কর।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, প্রায় ১০ বছর আগে আরাভ নিজের টাকায় গ্রামে একটি পাকা ওয়ালের টিনশেড বাড়ি করেন। সেখানে আরাভের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বাবা-মা বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি আসলে বড় অংকের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতেন। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই একমাত্র ছেলে, বাবা-মা এবং দুই বোনকে সেখানে নিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের গ্রামের বাড়ি ফাঁকা। আরাভের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় তার মা এবং দুই বোনকেও আসামী করা হয়েছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের টার্গেট করে আরাভ একাধিক বিয়ে করেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে স্থানীয় লোকজনের। নিজ এলাকা কোটালীপাড়ায় ৫-৭ জন নারীকে আরাভ বিয়ে করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে এমন কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, সোহাগ মোল্লা ওরফে মোল্লা আপন, ওরফে রবিউল ইসলাম রবি, ওরফে শেখ হৃদি, ওরফে আরাভ খানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৯ টি ওয়ারেন্ট আমার থানায় এসেছে। আমি ওয়ারেন্টগুলো তামিল করার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার কোনো হদিস আমরা পাইনি।
২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান। এ ঘটনায় তার ভাই ডিএমপি’র বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ই জুলাই একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। মামলার এজাহার অনুযায়ী আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। তবে গত বৃহস্পতিবার আরাভ এক ফেসবুক লাইভে এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।