ভক্তি আন্দোলন ও নারীত্বের তকমা অতিক্রম করার গল্প

এক:
ভক্তি আন্দোলন সমাজ, ধর্ম আর রাজনীতির বাধাবিপত্তিকে ছাড়িয়ে ভারত জুড়ে এক অভূতপূর্ব মানবতার বার্তা ছড়িয়ে একটি অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। ভক্তিবাদীরা প্রচার করেন, সমস্ত ধর্মই সমান। প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড ভক্তি ও সমর্পণই মুক্তির পথ। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার কাজে, জন্মের ওপর নয়। ভক্তিবাদে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন হয় প্রেমের দোহাইয়ে।

এই আন্দোলন মধ্যযুগে এনে দিয়েছিল স্বস্তির দমকা হাওয়া যা এই উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এই ভক্তি সুর-মাধুর্যে মানুষের মধ্যে দিয়েছিল এক মুক্তির বার্তা। জনমানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল মুক্তির গান। কি সামাজিক ভাবে, কি ধর্মীয়ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও।

ভক্তি আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুধু সমাজ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, নারী-পুরুষের সামাজিক- লৈঙ্গিক বৈষম্য ভাঙতেও ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু সেই আন্দোলনে বেশকিছু দিক বদলকারী প্রভাব রেখেছিলেন নারীরাই।

পর্যবেক্ষকরা নানা কারণে মধ্যযুগে ভক্তি আন্দোলনে নারীর এই অংশগ্রহণকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এ আন্দোলনে শুধু নারীদের অংশ নেয়াই নয়, মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে এবং এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে নারীর আচার, চলন-বলনও বিশেষ গুরুত্ব রাখে যা আলাদাভাবে লক্ষ্য করার মতো।

ভক্তিবাদে সঙ্গীত ভাব প্রকাশের এক বিশেষ মাধ্যম। ভক্তিগানে দেখা যায়, শিব বা কৃষ্ণের প্রতি ভক্তের প্রগাঢ় ভক্তি, নিষ্ঠা ও গভীর অনুরাগ নারী মনের অনুভূতির স্বরূপ দিয়েই প্রকাশ ও বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি পুরুষ কবি ও সাধকরাও নারীর ভাষায় ভাবে, রঙে নিজের ভক্তিকে রাঙিয়ে ঈশ্বর বা আরাধ্যের কাছে উপস্থাপন করেছেন। নারীর আকুলতা, আরাধ্যের প্রতি তার প্রবল সমর্পণের ভঙিটিই যেন এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই অনেক সময়ই নারীর বয়ানে, নারীসুলভ অনুভূতি ধারণ করে তারা তাদের ভক্তিগান বেঁধেছেন যেখানে আরাধ্য কৃষ্ণই একমাত্র পরম পুরুষ আর ভক্ত মাত্রই নারী। এখানে ‘নারীত্ব’ নারীর নয়, প্রেমিক-ভক্তের বৈশিষ্ট্য।

নারী সাধক যারা, তারা যেন অনেকটাই সহজাতভাবে, অবলীলায় উপাস্য শিব বা কৃষ্ণের প্রতি নিজেকে সমর্পিত করেছেন। প্রভু ও প্রেমিক হিসেবে বরণ করে একাত্ম হয়েছেন তাদের সাথে। আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, ভক্তিবাদে আত্মসমর্পণ করে প্রেমময় বিলীন হওয়াই আসল কথা।

আবার এইসব নারী সাধকরা নিজেদের ভক্তি ও সাধন নিষ্ঠায় ‘নারীত্বে’র তকমা ছাড়িয়ে এমনই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন যে সমগ্র ভক্তি আন্দোলনেই তারা নারী-পুরুষের বিভাজনের দেয়াল ভেঙে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন, যার ফলে সাধারণের কাছে অনুপম ‘সাধক’ হিসেবে তারা বরণীয় আর গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিলেন।

তবে পুরুষ সাধকদের তুলনায় নারী সাধকদের সামাজিক লড়াই ছিল আলাদা। পুরুষরা গার্হস্থ্য বজায় রেখে আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে সক্ষম হলেও নারীদের গার্হস্থ্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, বৈবাহিক সম্পর্ক ত্যাগ করেই এ পথে আসতে হয়েছে। স্বামীদের কাছ থেকে প্রভুত্বের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সংসার ছেড়ে তবেই ঈশ্বরের পথে যাত্রা করতে হতো তাদের। সবকিছু ছেড়ে এ এক কঠিন ত্যাগ ছিল তাদের।

ভক্তি আন্দোলন এভাবে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা ভূমিকা নিয়েই এসেছে। আমরা দেখতে পাই, মধ্যযুগে নারীর সাথে সাক্ষাৎ করা, কথা বলা, না বলার ক্ষেত্রেও পুরুষ সাধকরা অনেক ক্ষেত্রেই অনমনীয় ছিলেন। কিন্তু নিজ ব্যক্তিত্ববিভায় উজ্জ্বল নারী সাধকরা নারী-পুরুষের অসমতার সেই বাধাকেও ভেঙে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত।

দুই
মধ্যযুগের প্রথম দিকে ভক্তি আন্দোলন বর্ণ বৈষম্য প্রথা ভেঙে হিন্দু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। কানহোপাত্র, আণ্ডাল, মুক্তা বাঈ, জনা বাঈ, মহাদেবী আক্কা, আম্মাইয়ার, মীরা বাঈ প্রমুখ নারী সাধকরা ভক্তিবাদ বা ভক্তি ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

৬ষ্ঠ শতকে দক্ষিণ ভারতে অঙ্কুরিত হওয়া ভক্তি আন্দোলন ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি সমাজের উপর মহলের ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে প্রান্তিক মানুষের সহজ, সরল আর বোধগম্য ভাষার ব্যবহার করেছিল যা কৃষক, কারিগরসহ সমাজের নিচুতলার মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। তবে একথা বলতেই হবে, ভক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট ছিল ভক্ত, এমনকি সাধক হিসেবে এককভাবে নারীদের উত্থান।

এই নারী সাধকরা যৌনতা ও লৈঙ্গিক পরিচয়কে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন। সামাজিক কাঠামো, আচরণ, বাধা-নিয়ম, লজ্জা, শঙ্কা হটিয়ে সাধক আক্কা, লাল্লা পোশাক ফেলে নগ্ন হয়ে নাচতেন। বাহ্যিক পরিচয় ও সামাজিক বাস্তবতাকে ছাপিয়ে ভক্তির যাত্রায় শঙ্কাহীন এগিয়ে গিয়েছিলেন সে সময়ের নারী সাধকরা।

তিন
কৃষ্ণভক্ত রাজপুত কন্যা মীরা বাঈ চিত্তোরে প্রাসাদ ছেড়ে পথে নেমেছিলেন। স্বামী ও পরিবারের নির্যাতন, চাপের কারণে কাশ্মীরের লাল্লা এবং রূপা বাওয়ানি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ওপর চাপানো বিধিনিষেধ ও নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে তাদের এই পদক্ষেপ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

ভক্তি আন্দোলনে তেমনই প্রভাব রাখা অনন্য তিন নারী সাধক আন্ডাল, আক্কা মহাদেবী ও মীরা বাঈয়ের জীবনকথায় আমরা সেই সূত্র সন্ধান পাই। মীরা নিজ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে। প্রাসাদ, গার্হস্থ্য জীবন, লোকলজ্জা ছেড়ে একাই পথে নেমেছিলেন তিনি। আলবারদের মধ্যে একমাত্র নারী সাধক আণ্ডাল একমাত্র কৃষ্ণকেই স্বামীরূপে মানার পণ করেছিলেন। নিজ পছন্দকে অনুসরণ করতে শক্তি ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে কৃষ্ণের গলাতেই বরমাল্য দিয়েছিলেন তিনি।

কর্ণাটকে জন্ম নেয়া সাধক আক্কা মহাদেবী বা মহাদেবী আক্কাও রাজবধু ছিলেন কিন্তু শিব সাধনায় বাধা পেয়ে বস্ত্রহীন হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

মধ্যযুগের সপ্তম-অষ্টম শতকে দক্ষিণ ভারতের নারী সাধক ও কবি আন্ডাল তার ভক্তি ও প্রেম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। প্রেম-ভক্তি-রস ছড়িয়ে আলবাররা যে নব ভক্তিবাদের সূচনা করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিকভাবে যে বারো জন আলবারের কথা আমরা জানতে পারি তাদের মধ্যে আন্ডাল একমাত্র নারীসাধক ও কবি।

দক্ষিণ ভারতের তামিলভাষী অঞ্চলে, পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীতে কবি ও সাধক ‘আলবার’রা তাদের প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে সমগ্র ভারতেই এক নতুন ধারায় ধর্মীয় সম্মিলনকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আলবাররা ছিলেন মূলত ভ্রমণকারী। তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে তারা গাইতেন বিষ্ণু ভক্তির কাব্য- তিরু বায়মোলি বা মুখের বাণী। সহজবোধ্যতাসহ নানা কারণে এই গান সেসময়ে বেশ জনপ্রিয়তা আদায় করতে পেরেছিল। এ গানের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্ষিতিমোহন সেন তার‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা গ্রন্থে বলছেন, ‘তিরু বায়মোলি’ বা মুখের বাণী বেদের অপেক্ষা বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে অধিক সমাদৃত।

মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া এসব ভক্তিমূলক গান সব শ্রেণি-বর্ণ-পেশার লোকজনদের আকৃষ্ট করত, তাদেরকে তাড়িতও করত। আলবাররা ভারতবর্ষের চিন্তায় ঐশী-প্রেমের অনন্য বৈশিষ্ট নির্মাণের পাশাপাশি একটা স্বতন্ত্র ঐতিহ্যও নির্মাণ করেছিলেন। আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় পূর্বে নারী সাধক আন্ডাল সেই ঐতিহ্য নিমার্ণের অন্যতম কারিগর হিসেবে আজও সমাদৃত। আন্ডালের রচনায় উঠে এসেছে প্রেমভক্তির অসাধারণ এক অনুভব। তার রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় অলৌকিক এক আকুলতা। তিনি মমতামাখা ভাষায় লিখছেন,

আমার দূত হও, হে কালো মেঘ
ঘন মেঘ ভাঙে মাথায়
অন্ধকার পৃথিবীতে
বৃষ্টি ঝরে মুক্তার মত।
সহৃদয় আমার!
কেঁপে কেঁপে উঠছে বৃক্ষের শাখা
আকাশের কোলে,
কী সংবাদ এনেছো বয়ে সেখান থেকে
রুদ্র দেবতার আমার?

তোমার ছায়া নেমে এলো,
গভীরতর হলো রাত্রির কালো
আমি জ্বলি
পুড়ি ভালোবাসায়, ঘুমহীন।
তোমার দখিনা বাতাস জমালো ঘোর,
বাঁচাও আমায়–
আমি পুড়ে মরি
তুমি রাত্রির রঙ, যেন বৃষ্টি অঝোর
শব্দ তার আমাকে করছে আদর,
অলৌকিক সঙ্গীতে আনে খবর বয়ে
আমার প্রিয়তমের
নিকষ আঁধারে,
আকাঙ্ক্ষার প্রহর যায়, আর আমি তার মাঝে
এ দেহ পুড়িয়ে জ্বলি!
জানি,
অন্ধকারেই তো পরম ঢালেন সুধা।
তবু আমি বঞ্চিত, হায়, আসেনি সে আজও!
আমার অঙ্গারে আমি তড়পাই
ধরা না ধরায়, ডুবি-ভাসি
হারাই।

চার
ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য কর্ণাটকে জন্ম নেয়া সাধক আক্কা মহাদেবী বা মহাদেবী আক্কার অবস্থান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কন্নড় সাহিত্যের প্রথম দিককার নারী কবি হিসেবেও আমরা তাকে পাই।

দ্বাদশ শতকে কর্নাটকের উড়ুতাড়িতে জন্ম নেয়া আক্কা শিবকে প্রাণনাথ হিসেবে মেনেই বেড়ে উঠেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, স্থানীয় রাজা তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। বস্তুজগতের প্রতি নিস্পৃহ আক্কা মহাদেবী শিব সাধনায় বাধা পেলেন। রাজার নিগ্রহ যখন তাকে দমাতে পারল না তখন রাজা নির্দেশ দিলেন, তাকে যদি যেতে হয় তাহলে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তবে যেতে হবে।

তখন আক্কা আর কী করবেন? তাকে তো তার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সব ছেড়ে ছুঁড়েই যেতে হবে। তিনি তাই করলেন। আক্কা তখন সবকিছু ছেড়ে এমনকি নিজের পরিধেয় বস্ত্র বিসর্জন দিয়ে পায়ে হেঁটে কল্যানা নামের এক শহরের দিকে যাত্রা করলেন। পুরুষ সাধুদের মধ্যে নগ্ন হয়ে সাধনা প্রচলিত থাকলেও নারী হিসেবে তার এই নগ্নরূপ ছিল প্রথাবিরোধী সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু তার নগ্নরূপ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজ ব্যক্তিত্বে ভক্ত-সাধকদের মাঝে তিনি অশেষ ভক্তির জায়গা তৈরি করে মন জয় করে নিয়েছিলেন।

সে আমলে কল্যানা শহর ছিল সব বিখ্যাত সাধক-গুরুদের আবাস। বিজ্ঞ গুরুদের সাথে দর্শন ও আধ্যাত্মবাদ নিয়ে মকশা বা তর্ক-আলোচনায় যেতেন আক্কা। আধ্যাত্মিক আলোচনায় তার জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত বাসবান্নাসহ (Basavanna) লিঙ্গায়াত সাধুরা তাকে বিশেষ সন্মান জানিয়ে আক্কা অর্থাৎ বড় বোন ডাকা শুরু করেন।

আক্কার কবিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিক মুক্তি সাধনার নিদর্শন। মোক্ষের অনুসন্ধানে আক্কা শব্দের আলো জ্বেলে ‘আমিত্ব’কে ঘুচিয়ে দিয়ে, পরম চেতনায় নিজেকে বিলীন হয়ে যাবার সুগভীর এক দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। শিব, ‘চেন্নামল্লিকার্জুন’ রূপে কবিতায় আক্কা মহাদেবীর সাধনার লক্ষ্য।

আমরা তার কবিতায় সন্ধান করি পারলৌকিক এই জগত থেকে অন্য এক জগতের যেখানে নির্বাণ লাভের মধ্যে দিয়ে নিজের আত্মার মুক্তি।

১.
কে খোঁজে ফুল
বুকে সুগন্ধি টেনে নিতে?
শান্তি, দয়া কিংবা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে
প্রয়োজন কি তার কঠোর যোগের!
সারাবিশ্বই যখন একটি মাত্র মুখ
নির্জনতায় তার কীইবা আর সুখ?
ও শংকর, সে যে সাদা জুঁই ফুল!
২.
বসন খসে গেলে লজ্জা পায় নারী ও পুরুষ,
যখন জীবনদাতা প্রভু নিজেই দেহহীন
তখন তুমি কীভাবে হবে শালীন?
প্রভুর চোখ বিছানো তো এই সারা জগতেই,
দেখছে যখন সে খুঁটিনাটি সবই
কী ঢাকবে বলো আর কী লুকাবে তুমি?

পাঁচ
মীরা বাঈকে পুরো ভারত জুড়ে ভক্তি আন্দোলনকে প্রভাবিত করা সবচেয়ে খ্যাতিমানদের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাঁচশ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও সমান জনপ্রিয় বৈষ্ণব-সাধক মীরা বাঈর ভজন।

গবেষকরা বলছেন, কৃষ্ণরূপ গিরিধরের জন্য মীরার আকুলতা যেন সব কিছু ছাপিয়ে কালজয়ী। মীরার সঙ্গীত ও নৃত্য যেন দেহ ও মনের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। তার সঙ্গীত দরবেশদের ঘূর্ণি নাচের মতই অতল রহস্যময় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন।

চিতোরের যুবরাজ ভোজরাজের সাথে বিয়ে হয় মীরার। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে মীরার বৈরাগ্যভাব প্রকাশ হয়ে পড়ে। তার সময় কাটে মন্দিরে। কৃষ্ণপূজা আর ভজনে। ভোজরাজ মারা গেলে প্রাসাদে স্বাধীনচেতা মীরা হয়ে উঠলেন সবার চক্ষুশূল। এমনকি তাকে দুবার বিষ মিশিয়ে হত্যা চেষ্টা করেন রাজপুত্র রানা।

এরই মধ্যে মীরার ভজন-সাধনের টানে তাকে ঘিরে চিতোরে গড়ে উঠেছিল এক ভক্তগোষ্ঠী। তার ভজন রাজস্থানের উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। মধ্যযুগের এক রাজপুত রাজবধূ থেকে আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ওঠেন মীরা। তবে কিছুদিনের মধ্যেই প্রাসাদ ছেড়ে তিনি বেছে নেন আলাদা এক জীবন। সে জীবনের নাম হচ্ছে পরিভ্রমণের জীবন। উত্তর ভারতের গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি। জাতিতে মুচি, সাধক-কবি রবিদাসের শিষ্য হিসেবে খ্যাত মীরা একসময় কৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবনে পৌঁছান। সেখানে শ্রী চৈতন্যের অনুসারী শ্রীরূপ গোস্বামীর সাথে তার দেখা হয়।

ক্ষিতিমোহন সেন তার ‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’ গ্রন্থে উল্লেখ রেছেন, ‘মীরা বাঈ যদিও রবিদাসের শিষ্য বলিয়াই খ্যাত তবু বৃন্দাবনের জীব গোস্বামীর সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা আছে। অনেকে মনে করেন তার ওপর গৌড়ীয় মতের প্রভাব কতক পরিমাণে ছিল। এ কথা বিচারসাপেক্ষ।
বলা হয়, রূপ গোস্বামী কোনো নারীকে দেখা দিতেন না, তাই মীরাকেও তিনি ফিরিয়ে দেন। তখন মীরা তার শিষ্যের কাছে চিরকূট লিখে পাঠান যেখানে মীরা লিখছেন,

কোনোদিনও শুনি নাই শ্রীধাম বৃন্দাবনে,
আর কোনো পুরুষ আছে একা কৃষ্ণ বিনে।
আমি তো জানতাম,বৃন্দাবনে একমাত্র পুরুষ হলেন গোবিন্দ বাকি সবাই প্রকৃতি।                                                                                            গোপীভাবে ভজনা করলে তবেই গোবিন্দের কৃপা পাওয়া যায়।                                                                                                                        তবে আর পূঁজারি পুরুষভাবের হন কী করে!

এই চিরকুট পেয়ে রূপ গোস্বামীর বোঝার বাকি থাকে না যে মীরা আসলে কোনো সাধারণ সাধক নন। তিনি সিদ্ধান্ত বদলে মীরার সঙ্গে দেখা করেন। এই সময়ে বৃন্দাবনে কৃষ্ণপ্রেমে অনেকগুলো ভজন রচনা করেন মীরা।

ছয়
শেষের বছরগুলোতে গুজরাটের দ্বারকায় সন্ন্যাসীনি রূপে মীরা বাঈকে সেখানে দেখা যায়। তবে ১৫৪৬ সালের পর আর তার দেখা মেলেনি। বলা হয়, অলৌকিক প্রেমে দ্বারকায় কৃষ্ণমন্দিরে রণছোড়জির বিগ্রহে বিলীন হয়ে যান তিনি।

মীরার গান কৃষ্ণের প্রতি সম্পূর্ণ আত্ম নিবেদনের। একইসঙ্গে তার পদগুলো তীব্র প্রেমময় আকাঙ্ক্ষার দ্রবণে নিমজ্জিত। মীরার ভজনের সংখ্যা হাজার পাঁচেক বলা হলেও বাস্তবিক চার-পাঁচশ’র মতো ভজন পাওয়া যায়।

১.
নন্দদুলাল, ঘনশ্যাম ঘিরে ধরেছে আমায়,
জমছে কালো মেঘ, গর্জায় কী ভীষণ
পূব থেকে ছোটে হাওয়া, বিজুলি চমকায়!
ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে ময়ূর পেখম মেলে
কোকিল ডাকছে কুহু হায়
মীরার প্রভু যে গিরিধর নাগর
পদ্মচরণে তার মন আটকায়।

২.
হরি বিনে আমি বাঁচিরে কিভাবে
ঘুণে ধরা কাঠ যেমনটা হায়
পাগলিনী আমি তাহার বিহনে
এ অসুখের কোনো নিদান নাই।
জলের মাছ যে বাঁচে না ডাঙায়
বাঁশিতে তাহার এ প্রাণ যায়,
বনে-জঙ্গলে ঘুরি অচেতনে,
মীরার খুশি তো গিরিধরায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আন্দোলননারী