থিয়েটার, মঞ্চ, নাটক সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই বলাবলি করতেন, আহমেদ রুবেলদের মতো উচ্চমানের অভিনেতাকে এ দেশে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয় না। প্রায়শই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন সদ্য প্রয়াত এই অভিনেতাও! বিনয়ে এড়িয়েই গেছেন এমন প্রশ্ন! তবে কাজের সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ায় চাপা কষ্ট যে ছিল দাপুটে এই অভিনেতার, তা কি আড়াল করতে পারতেন?
এই নিভৃতচারীর প্রয়াণে আবারো নতুন করে বিষয়টি আলোচনায়। আহমেদ রুবেলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি- এমন আলোচনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে শিল্পকলা একাডেমিতে তারই শেষ শ্রদ্ধায়।
অনেকেই অভিযোগের সুরে বলতেন, আহমেদ রুবেলকে ঠিকভাবে পাওয়া যেত না। অনেকেই ভয় পেতেন, তিনি শুটিংয়ে নিয়মিত সঠিক সময়ে আসবেন কিনা! রুবেলকে নিয়ে এমন ছড়িয়ে যাওয়া কথা কতোটা সত্যি? সেসব বিষয়ও এদিন উঠে আসলো অভিনেতার নিকটজনদের বয়ানে!
নির্মাতা নূরুল আলম আতিকের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন আহমেদ রুবেল। এদিন রুবেলকে স্মরণ করতে যেয়ে এই নির্মাতা বলেন, তাকে নিয়ে কিছু ভুল মিথ প্রচলিত ছিল। আমার পরের প্রজন্মকে একাধিকবার বলেছিলাম তোমাদের যদি তাকে নিয়ে এতই সংশয় থাকে তাহলে আমাকে বলবা। তার সঙ্গে আমি থাকবো। আমি এইটুকু বুঝি রুবেল ভাইয়ের যে অভিনয় সক্ষমতা সেটা সঠিকভাবে আবিষ্কার করার মতো অনেকেই নেই। আমি বলবো, তাকে স্ক্রিনে ইউজ করা হয়নি। আমরা শুধু তার বাইরের দেমাগ দেখেছি, কিন্তু তার হৃদয়ের লুকায়িত আকাঙ্ক্ষা কেউ বিকশিত হতে দিতে পারিনি। তাই বলতে চাই, রুবেল ভাইয়ের মতো যারা অভিনয়ের দাপট দেখান তাদেরকে কাজে লাগান।
নাট্যজন রামেন্দ্র মজুমদার বলেন, রুবেলের মতো যারা মেধাবী অভিনেতা তাদের নামে কিছু না কিছু অপবাদ প্রচলিত হয়। আসলে এগুলো সত্যি নয়। আহমেদ রুবেল তার যোগ্যতা অনুযায়ী হয়তো কাজ করে যেতে পারেননি, কিন্তু যা যা করতে পেরেছে আমি মনে করি সেগুলো অক্ষয় হয়ে থাকবে।
দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ-এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে যতজন শেখ মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করেছে আমার কাছে মনে হয় রুবেলই পারফেক্ট ছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, রুবেলকে সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে, এমন পারফেক্ট অভিনয় কীভাবে হয়? হয়তো আমরা তাকে ভালোবাসি। কিন্তু প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসি না। হয়তো দূর থেকে রুবেলের কড়া সমালোচনা করেছি, তার কাছে গিয়ে হয়তো কেউ বলিনি রুবেল তুমি কাজ করো।
সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, আহমেদ রুবেল কখনো সস্তা জনপ্রিয়তার ধার ধারেননি। তিনি তার গুণ ও মেধা দিয়ে কাজ করেছেন। তার শিল্পী সত্তাকে কখনো বিক্রি করতে দেখিনি। এই হলো আহমেদ রুবেল। আসলে প্রকৃত শিল্পীদের আচরণ এমনই হওয়া উচিত। তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
অভিনেত্রী জোতিক্যা জ্যোতি জানান, তার ক্যারিয়ারে সর্বাধিক কাজের পুরুষ সহশিল্পী আহমেদ রুবেল। এই অভিনেতার মৃত্যুর খবর শুনে বুধবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন জ্যোতি। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে অশ্রুসিক্ত চোখে হাজির হয়েছিলেন শিল্পকলা একাডেমিতে।
সেখানে জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, ইন্ডাস্ট্রি মেধার জায়গা থেকে অনেক বামন। এ কারণে রুবেল ভাইয়ের মতো দরাজ কণ্ঠ এবং মেধাবী অভিনেতাকে হ্যান্ডেল করতে পারেনি। আমার সঙ্গে সর্বাধিক নাটক ও চলচ্চিত্রের তিনি অভিনয় করেছেন। প্রচুর আউটডোর শুটিং করেছি। আমি রুবেল ভাইকে কখনো দেরিতে শুটিংয়ে আসতে দেখিনি, কখনো দেখিনি তার জন্য কোনো শুটিং ইউনিট ফেঁসে গেছে। আসলে যে শুটিং ইউনিট ঠিক থাকতো না, সেখানে রুবেল ভাই ঠিক থাকতেন না। যারা বলছেন, রুবেল ভাই নিজেকে ধ্বংস করেছেন, আমি মনে করি এগুলো ভালোবাসা প্রকাশের নামে এক ধরনের অপপ্রচার। রুবেল ভাইকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল।আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যারা বেশি যোগ্য তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়।
ঢাকার অদূরে গাজীপুরের জয়দেবপুরের উত্তর ছায়াবিথীতে থাকতেন আহমেদ রুবেল। তিনি সবসময় চাইতেন, এক্সপেরিমেন্টাল ক্যারেক্টার করতে। কিন্তু তার কাছে ঘুরে ফিরে একই চরিত্র আসতো। এই অভিনেতার ঘনিষ্ঠজন ও নির্মাতা শ্যামল শিশির জানান, আহমেদ রুবেল ছিলেন প্রকৃত শিল্পী। আর একজন প্রকৃত হয়ে তিনি গতানুগতিক চরিত্র একাধিকবার করতে চাইতেন না। এ কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অভিনয়ে অনিয়মিত ছিলেন তিনি।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নূরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ ছবির উদ্বোধনী শো’তে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো আহমেদ রুবেলের। শো’তে যোগ দিতে বসুন্ধরা শপিং মলের বেজমেন্টে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান। সেখানে মাথায় পানি দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর পার্শ্ববর্তী স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে সন্ধ্যা ৫টা ৫৮ মিনিটে ডাক্তার আহমেদ রুবেলকে মৃত ঘোষণা করে জানায়, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রুবেলের মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ আহমেদ রুবেলের মরদেহ রাখা হয় মোহাম্মদপুর মারকাজুলের হিম ঘরে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে তাকে মঞ্চ, নাটক ও থিয়েটার কর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শিল্পকলায় তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে আহমেদ রুবেলের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর চ্যানেল আই থেকে ‘বৃক্ষমানব’ খ্যাত অভিনেতার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরে। সেখানে উত্তর ছায়াবীথি, জোড় পুকুরে আসর বাদ হবে অভিনেতা আহমেদ রুবেলের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা এবং দাফন।