জীবনে এত দুঃসময় আসবে তা কখনই কল্পনা করেননি আশি ও নব্বই দশকের অন্যতম অভিনেত্রী, ব্লাকবেল্ট কন্যা রঞ্জিতা। কিন্তু পারিবারিক বিবাদ, ছোট বোন আর তার স্বামীর ষড়যন্ত্র এবং সম্প্রতি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে যেনো জীবনের সব কূল-কিনারাই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
সুচিকিৎসার জন্য যে অর্থকড়ি প্রয়োজন তাও তার কাছে নেই। এখন তাই বাঁচার আকুতিটাই কেবল করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।
২৮ সেপ্টেম্বর বনশ্রীর ভাড়া বাসায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হন রঞ্জিতা। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। মডেল উল্কা হোসেন, অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, অভিনেত্রী নাসরিন, শাহনুর, সাংবাদিক দুলাল খান শুভাকাঙ্খি উজ্জ্বল এদের তাৎক্ষণিক সহায়তা ও প্রচেষ্টায় তার চিকিৎসা চলে।
অরুণা বিশ্বাস রঞ্জিতার চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য ফেসবুক লাইভে আহবানও জানান। এরপর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, নায়ক বাপ্পারাজ, নায়িকা রত্না সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। কিছুটা সুস্থ রঞ্জিতা তিনি বাসায় ফিরে আসেন। কিন্তু স্ট্রোকে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছেন। শরীরের কিছু অংশ তার প্যারালাইজ হয়ে গেছে। আর মানসিক চিন্তা ও অবসাদে স্মৃতি শক্তিও তার কমে আসছে। এখন স্থিরভাবে কথা বলতে পারেন না। প্রতিদিন ফিজিওথেরাপি নিতে হচ্ছে। আর্থিক সামর্থ না থাকায় কেবলই অন্ধকার দেখছেন।
আশির দশকের শেষলগ্নে চলচ্চিত্রে পা রেখেছিলেন অভিনেত্রী রঞ্জিতা। চলচ্চিত্রের সেই সোনালী সময়ে কবরী, শাবানা, ববিতা, নূতন, রোজিনা, সূচরিতা ক্রেজ সর্বত্র। সে সময় নায়ক রাজ রাজ্জাকের হাত ধরে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। নায়ক রাজ রাজ্জাকের ছেলে বাপ্পারাজের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘ঢাকা ৮৬’ ছবিতে। প্রথম ছবিতে অভিনয় করেই তিনি পরিচিতি পান। কিন্তু সেই পরিচিতির পরিধি ভীষণরকম বিস্তৃত হয় এই ছবির ‘পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হ্নদয়, ভেঙে যায় যাক তার করিনা ভয়’-এই জনপ্রিয় গানের লিপে। এই গানটিতে বাপ্পারাজ আর তিনি লিপ করেন।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় আনোয়ার পারভেজের সুরে নন্দিত কণ্ঠশিল্পী শাকিলা জাফর এবং তপন চৌধুরীর গাওয়া এই প্রেমময় গানটি বাপ্পা রাজ এবং রঞ্জিতা দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। নৃত্যপরিচালক আমীর হোসেন বাবুর নির্দেশনা আর মাহফুজুর রহমানের অসাধারণ ক্যামেরা ওয়ার্কে এই গানটি এতোটাই শিল্পীত রুপ ধারণ করে যে- গানটি কালজয়ী হয়ে আছে। ‘ঢাকা ৮৬’ ছবির পর তিনি অভিনয় করেন ‘রাজামিস্ত্রী’, ‘জীনের বাদশা’, ‘কংফু কন্যা’, ‘মরণ লড়াই’, ‘ক্যারাটি মাস্টার’, ‘প্রেমিক রংবাজ’সহ ২৯টি ছবিতে। এক ডজনেরও বেশি ছবিও প্রযোজনা করেন তিনি। ক্যারিয়ারের সোনালী সময়ে ৯২ সালে বিয়ে করেন অভিনেতা-প্রযোজক জাহাঙ্গীরকে। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। মাত্র ছয় বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায়। সে ঘরে এক ছেলে রয়েছে রঞ্জিতার।
ঢাকাতেই বড় হওয়া রঞ্জিতার শৈশব-কৈশর ছিল দারুণ উচ্ছল এবং রঙিণ। পরিবারে আভিজাত্য ও প্রাচুর্যও ছিল প্রচুর। বাবা মায়ের সংসারে স্বাচ্ছন্দে হেসে খেলে তাই বড় হয়েছেন। ইংরেজি নিয়ে লেখাপাড়া করেছেন ইডেন কলেজে। বাবা ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পাসপোর্ট এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ইমিগ্রেশন অফিসের পরিচালক হিসেবে অবসরে যান। নায়ক রাজ্জাকের সাথে ছিল রঞ্জিতার বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সেই সুবাদেই রঞ্জিতাকে ছেলে বাপ্পার বিপরীতে নায়িকা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন তিনি। সিনেমাতে এসেছিলেন তিনি নিছক কৌতুহল আর ভালোবাসা থেকে।
নব্বই দশকের পর আমাদের সিনেমা জগতের দুঃসময় শুরু হলে রঞ্জিতাও ধীরে ধীরে সিনেমা জগতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। ২০০৫ সালে নায়ক রুবেলের সাথে ‘প্রেমিক রংবাজ’, ২০০৮ সালে ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে ‘কংফু কন্যাতে অভিনয় করেন। শেষ ছবি ছিল ‘নীলনকশা’। এরপর অনেকটা আড়ালে আবডালেই চলে যান। সব দুঃখ হ্নদয়ে ধারণ করে বাঁচতে চেয়েছিলেন আপন মর্যাদায়। তাই কারো ধারস্থ হননি। নিজের মতো করেই চলছিলেন। কিন্তু পৈত্রিক বাড়ি থেকে আপন ছোট বোন আর তার হাজবেন্ড-এর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সব হারিয়ে ফেলেন তিনি। রঞ্জিতার জীবনের গল্প এখন সিনেমার মতোই। তিনি নিঃস্ব, রিক্ত এক সর্বহারা।
জীবনের এই দুঃসময়ে এসেছে বুঝেছেন ‘পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হ্নদয়’ সত্যি ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এ জন্য বাইরের কাউকে তিনি দোষী করেন না। সব ঘৃণা, ক্ষোভ তার ছোট বোন আর বোনের স্বামীর উপর। তাদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র আর লোভের বলি হয়েছেন তিনি এবং তার অন্যান্য ভাইবোন। রামপুরার পৈত্রিক কোটি কোটি টাকার বাড়ি থেকে এভাবে উচ্ছেদ হবেন ভাবতে পারেননি।
রঞ্জিতা বলেন, ‘জীবনে এত দুঃসময় আসবে ভাবিনি। চিকিৎসার টাকা নাই। দুচোখে এখন অন্ধকার। বাড়িটি উদ্ধার করতে পারলে হয়ত নতুনভাবে বাঁচার উদ্দীপনা পেতেন।’ অসুস্থ হওয়ার পর যারা তাকে ব্যক্তিগত সহযোগিতা করেছেন, খোঁজ খবর নিয়েছেন তাদের প্রতি রঞ্জিতার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার মতে, কিছু ভালোবাসার মানুষ ছিল বলেই তারা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন। তবে ক্ষোভও আছে।
আর তাই বলেন, মারা গেলে তার লাশ যেনো এফডিসিতে নেওয়া না হয়। তিনি বলেন, ‘জীবনে ছবি করেছি শখ থেকে। ছবি করতে গিয়ে কখনও পারিশ্রমিক নেয়নি। সবসময় সবার কল্যাণ কামনা করেছি। ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যানদের পরিবারের কল্যাণে ফান্ড তৈরি করবার জন্য আমার দ্বিতীয় ছবি ‘জিনের বাদশা’ মাত্র এক টাকায় সাইন করেছিলাম। আর এখন আমার সব সোনামাখা দিন অতীত হয়ে গেছে।’
রঞ্জিতা এখন বিষাদময় এক জীবন পার করছেন। অনেকটা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো। তবে তিনি মনে করেন, তার এই দুঃসময়ে তিনি প্রধানমমন্ত্রীর একটু সহযোগিতা চান। হয়তো প্রধানমন্ত্রী সহায়তার হাত বাড়ালে তিনি খানিকটা আশার আলো দেখবেন। তিনি আরেকটু বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাবেন।