বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা ও আরএসওর মধ্যে সংঘাতের জেরে শূন্যরেখার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গত পাঁচদিন ধরে বাংলাদেশের ভূখূণ্ডে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা। খোলা আকাশের নিচে তাবুতে মানবেতর দিন কাটানো রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এখনও সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের।
সে সঙ্গে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে টহল জোরদার রেখেছে বিজিবিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। বাসস্থান, খাদ্য, পানীয় ও টয়লেটসহ নানা সংকটে থাকা এসব রোহিঙ্গাদের দিন কাটছে চরম অনিশ্চিয়তায়।
রোহিঙ্গারা বলছে, শূন্যরেখায় ক্যাম্পের ধ্বংসস্তুপে ফিরে যেতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছেন। কারণ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কখন আবারও সংঘাতে জড়ায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয় নিলেও তারা খাদ্য ও বাসস্থানসহ নানা সংকটে রয়েছে।
গত ১৮ জানুয়ারি বুধবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কোনারপাড়া শূণ্যরেখা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় একজন নিহত এবং এক শিশুসহ দুইজন আহত হন।
পরে ওইদিন বিকালে গোলাগুলির ঘটনার রেশ ধরে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে ক্যাম্পের সবকটি ঘর পুড়ে গেছে। ঘটনার পর ক্যাম্পের সাথে লাগোয়া সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে কয়েক শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু আত্মরক্ষার্থে মিয়ানমার ভূখণ্ডে চলে যায়। আরও কয়েক শত রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্পের নিকটবর্তী তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ, তৎসংলগ্ন পতিত জমি ও তুমব্রু বাজার এলাকায় আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমার ভূখণ্ডে চলে যাওয়া রোহিঙ্গারাও গত শুক্রবার পুনরায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তুমব্রু বাজারের আশেপাশে অবস্থান নিয়েছে। তারা ভয়-আতংকে শূন্যরেখার ক্যাম্পে ফিরতে চাইছে না বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন সেখানে পলিথিন, বাঁশ ও ত্রিপলসহ অস্থায়ী উপকরণ দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি অবস্থান করছে। এতে তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে আশ্রয় নেওয়া রফিকুল ইসলাম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, বুধবার ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে মিয়ানমার ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে একদিন অবস্থানের পর শুক্রবার মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি জোর করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা নাগরিক হাফেজ আহমদ বলেন, ‘মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর আগেরই দুর্দশায় পড়েছে এতদিন ধরে শূন্যরেখায় বসবাসকারি রোহিঙ্গারা। এখন ঠিকানা বিহীন দুঃশ্চিন্তায় কাটছে তাদের জীবন। বিবাদমান সশস্ত্র দুইগ্রুপের মধ্যে সংঘাতের জেরে শূণ্যরেখায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ক্যাম্পে ফিরে যেতে সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছেন।’
তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর রহিম বলেন, বুধবার সীমান্তে সশস্ত্র দুইগ্রুপের সংঘাতের জেরে বেশকিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা স্কুলসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এতে ওইদিন থেকে স্কুলের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। তবে রোববার থেকে স্কুলের প্রশাসনিক কার্যক্রম চললেও সোমবার বা পরদিন থেকে পাঠদান শুরু হবে।
নাইক্ষংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ‘কৌশলগত কারণে সব কথা বলা যাচ্ছে না। এতটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সীমান্ত পরিস্থিতি কঠোর নজরদারি করছে। শূণ্যরেখার ক্যাম্পে থেকে বের হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনী নিবিড় ও কড়া নজরদারিতে রেখেছে। শুণ্যরেখার ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড কত রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিজিবিসহ আইন প্রয়োগকারী স্বাস্থ্য সদস্যরা টহল জোরদার করেছে।’
তবে তমব্রুতে আশ্রয় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন ধরণের নির্দেশনা এখনো পাননি বলে জানান ইউএনও।
এ নিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘উদ্ভুদ পরিস্থিতিতে শূণ্যরেখার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক রেডক্রস-রেডক্রিসেন্ট কমিটি (আইসিআরসি) -এর মাধ্যমে শনিবার হতে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
এসব রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কি ধরণের অবস্থান নেওয়া তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।