১৭ মার্চ রোববার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪ তম জন্মদিন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের এই তারিখে মঙ্গলবার রাত ৮ টায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
নানা শেখ আব্দুল মজিদ তাঁর নাতির নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা শেখ লুৎফুর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুনের চার মেয়ে এবং দুই ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় বোন ফাতেমা বেগম ও মেঝ বোন আছিয়া বেগমের পর প্রথম পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করায় ছিলেন বাবা মায়ের বিশেষ আদরের। তাই বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুন আদর করে বঙ্গবন্ধুকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন । তিনি শেখ বংশের গোড়াপত্তনকারী শেখ আউয়াল দরবেশ আল-বগদাদী’র বংশধর।
তাঁর নসবনামা হলো শেখ মুজিবুর রহমান ইবনে শেখ লুৎফর রহমান ইবনে শেখ আব্দুল হামীদ ইবনে শেখ মহম্মদ জাকের ইবনে শেখ একরামুল্লাহ ইবনে শেখ বোরহানুদ্দীন ইবনে শেখ জান মাহমূদ ইবনে শেখ জহীরুদ্দীন ইবনে শেখ আউয়াল দরবেশ আল-বগদাদী। নানা শেখ আব্দুল মজিদ বঙ্গবন্ধুর নাম রাখার সময় বলে যান ”মা সায়েরা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম যে নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে।”
বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা রচিত “শেখ মুজিব আমার পিতা” প্রবন্ধে। তিনি বইটিতে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে।
তাঁর অনুসন্ধানী মন বুঝার চেষ্টা করতেন বাবুই পাখি কেমন করে বাসা গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা। দোয়েল পাখির সুর বঙ্গবন্ধুকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। অত্যন্ত মুক্ত ও উদার পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর মনের বিকাশ ঘটেছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ন্যায়পরায়ণ, হৃদয়বান ও মানুষের প্রতি সহমর্মী স্বভাবের অধিকারী ছিলেন।
এমনকি তিনি কৈশোর থেকেই খুব বেশি অধিকার সচেতন ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দুর্ভিক্ষের সময় নিজের গোলা থেকে ধান বিতরণ করতেন। সমিতি করে অন্যদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করতেন। গ্রামের এক গরীব ছেলেকে তাঁর শতচ্ছিন্ন কাপড় দেখে নিজের পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি দিয়ে এসেছিলেন। এমন অসংখ্য নজির বঙ্গবন্ধু কন্যার বইটিতে উল্লেখ রয়েছে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এদেশের প্রতিটি মানুষের অতি আপনজন। জাতি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালির জন্যই ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল অপরিসীম। যতদূর জানা যায় জাতির পিতা সেই অর্থে জন্মদিন পালন করতেন না, কিন্তু জন্মদিনটিতে তিনি শিশুদের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করতেন। ওইদিন শিশুরা দল বেঁধে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে যেত। বঙ্গবন্ধু আজীবন শিশুসহ আপামর জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে তাঁর সংগ্রাম এবং কথা বলার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি শিশুদের জাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও কল্যাণের ওপর গুরুত্বারোপ করতেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে আজকের শিশুরাই। তাই জাতির উত্তরাধিকার শিশুদের মঙ্গলের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে স্মরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে । তাইতো ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ থেকে দিনটি জাতীয়ভাবে ”জাতীয় শিশু দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৭ মার্চ এখন শুধু জাতির জনকের জন্মদিনই নয়, একই সঙ্গে এটি শিশুদের উদ্যাপন এবং তাদের অধিকার ও কল্যাণ সমর্থন করার জন্য নিবেদিত একটি দিবস। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায্যতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারকে অনুসরণ করে এদেশের শিশুরা দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং দেশকে অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথ দেখাবে- এটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা।
জাতির জনকের ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্ম ও উন্নয়নে তিনি যে গভীর উত্তরাধিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তা প্রতিফলিত করা অপরিহার্য। প্রতিটি কাজ যখন যেটা ন্যায় সংগত মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটি শাশ্বত সংগ্রাম ও দুর্বার আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণাবলি অনেক ছোট বয়স থেকে পরিলক্ষিত হলেও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুভ সূচনা হয়েছিল ১৯৩৮ সালের ১৫ ই জানুয়ারি।
সেদিন স্কুল পরিদর্শনে আসেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলু হক ও তাঁর বাণিজ্য ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে যার রাজনৈতিক আদর্শ বঙ্গবন্ধুকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। সেদিন স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একটি দল নিয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দাবি আদায়ে সফল হন। যার রোষানলে পড়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ৭দিনের জন্য প্রথম কারাবরণ করতে হয়েছিল। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম কারাবরণ। তার পর থেকে একের পর এক কারাবরণ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ২৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে প্রায় ১৪ বছরই কেটেছে জেলে। কারা প্রাচীরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মোট ৫১১০টি সোনালি দিন খরচ করেছেন জাতির মুক্তির জন্য। নেলসন ম্যান্ডেলার পরে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র রাজনীতিবীদ যিনি সর্বোচ্চ কারাবরণ করেন।
স্বাধীনতা নামক যে মহাকাব্য, তা রচনার মূল ভুমিকায় ছিলেন শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কল্পনা করাও অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব, তিনি নিছক একজন স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি জনগণের জন্য প্রাণান্তকরভাবে নমনীয়, অসীম সাহস এবং অটল উৎসর্গের প্রতীক ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালির প্রধান পথ প্রদর্শক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেদিন বঙ্গবন্ধুর তেজোদ্দীপ্ত তর্জনী এদেশের লাখ লাখ জনতাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল, একত্রিত করেছিল তাঁর বিশাল নেতৃত্বের ছায়াতলে।
স্বাধীনতার উন্মাদনায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে, এক অদম্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল বীর জনতা। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে খচিত হল এক নতুন অধ্যায়, এক নতুন নাম, যার নাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই বঙ্গবন্ধু একটি জীবন্ত ইতিহাস, একটি লাল-সবুজের পতাকা, একটি নতুন মানচিত্র, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমার্থক নাম।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের অন্যতম রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও মনীষীদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।
ব্রিটিশ জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশ করেছিল,শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। ফিনান্সিয়াল টাইমস ছেপেছিল, মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে, পয়েট অফ পলিটিক্স তথা রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
যুদ্ধবিরোধী ব্রিটিশ আন্দোলনকারী ও রাজনীতিবিদ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্যা ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা’। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আন্দোলনের আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জাপানের খ্যাতিমান অধ্যাপক, লেখক ও জাপান রেডক্রসের প্রাক্তন প্রধান পরিচালক ফুকিউরা তাদামাসা আজও বাঙালি দেখলে বলেন, তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ, হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।
বাঙালি জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহামূল্যবান জীবনের দুঃখজনকভাবে অকাল যবনিকাপাত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। যে স্বাধীনতার জন্য এত আত্মত্যাগ, সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নিজের ও পরিবারের তাজা রক্ত যোগ করে স্বাধীনতার ইতিহাসকে এক করুণ মহাকাব্যে পরিণত করে গেলেন স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর অকাল মৃত্যু সত্ত্বেও, ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে, তাঁর আদর্শ ও সংগ্রামের ইতিহাস বাংলাদেশ তথা বিশ্বের নিষ্পেষিত জনগণের জন্য আশা ও অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হিসেবে টিকে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল ধরে। বঙ্গবন্ধুর ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করার সময়, আসুন আমরা তাঁর আদর্শ ও নীতিকে সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি।
তাঁর স্মৃতিকে সম্মান করে আমরা এমন একটি জাতি গঠনের চেষ্টা করি যেখানে সকল নাগরিকের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪ তম জন্মদিনের অবিরাম শুভেচ্ছা সবাইকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)