ইতিহাসের বঙ্গদেশ জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাজী নজরুল ইসলামের বাংলাদেশ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলায়। পাঠ্য বইয়ের অনুশীলনের মত একটা নির্দিষ্ট ছক-বাঁধা পথে সকলের জীবন অগ্রসর হয় না, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনেও হয়নি। চল্লিশের দশকে উত্তাল জনস্রোত তাঁকে সম্পৃক্ত করে ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে এবং নিয়ে যায় জনজীবনের উপকূলে। রাজনৈতিক আন্দোলন-আলোড়ন ভাঙ্গা-গড়া উত্থান-পতন তাঁর জীবনের গতি-প্রকৃতিকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পুরো অংশটাই কেটেছে অস্থির আন্দোলনমুখর সময় ও পরিস্থিতির মধ্যে। তাঁকে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির পুরোভাগে থাকতে গিয়ে মূল্যও দিতে হয়েছে যথেষ্ট। তাঁর নিজের সব চাওয়া-পাওয়ার সীমা হারিয়ে গিয়েছিল অভাগা জনমানুষের আশা-আকাঙ্খার মাঝেই। এমনকি তিনিই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে দুর্দান্ত সাহসী ছাত্রকর্মী হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্তসমৃদ্ধ সাহসী এক মানুষ ছিলেন জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান।
ঘন কুয়াশা ও ভয়ংকর তুষার ঝঞ্চার আবরণ ভেদ করে সুদীর্ঘ সাড়ে তিন যুগ সময় ধরে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অকুতোভয় এক মানব-সন্তান, জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে মহামানবে পরিণত হয়েছিলেন তা অনেকেই খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছেন। দেশের অগণিত জনমানুষ দেখেছেন ১৯৪০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত কিভাবে ক্ষণজন্মা শেখ মুজিব রাজনৈতিক অঙ্গনে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলার এক প্রান্ত রূপসা থেকে পাথরিয়া আর আরেক প্রান্ত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত উল্কার মত ছুটে বেড়িয়েছেন অধিকারবঞ্চিত অভাগা শোষিত ও নিপীড়িত জনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, বিশেষত দুঃখী-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য কারও রক্তচক্ষুর পরোয়া না করেই। রাজনৈতিক সেই কঠিন দিনগুলোতে তাঁরই জন্য সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর মানসিক যন্ত্রণাও ভোগ করতে হয়েছিল গোটা পরিবারকে। আন্দোলন-সংগ্রামের তিনি ছিলেন স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে আপোষহীন, তা ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধের আগেই হোক বা জনযুদ্ধের পরেই হোক। জাতির জনক মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’তে রূপান্তরিত হওয়ার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
একজন নবীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার শুরুটাই করেছিলেন জনমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি-শান্তি আর কল্যাণের স্বপ্ন নিয়ে। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বার্থে জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ ও শান্তি এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যার ফলশ্রুতিতেই ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’-এর প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় বাংলাদেশের অধিকার বঞ্চিত জাতির মুক্তি আন্দোলন ও বিশ্বশান্তির স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের প্রস্তাব উপস্থাপিত হয় এবং পৃথিবীর ১৪০টি দেশের ‘শান্তি পরিষদ’-এর ২০০ জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি আর মতামতের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও করি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে গৃহীত হয়। এছাড়া, একই দিন ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ এক ইশতেহারে, গণতন্ত্র-স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা ‘বঙ্গবন্ধু’কে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’-এর সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেন।

ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭৩ সালের মে মাসে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ ঢাকায় দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন (তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার মাত্র ১ বছর ৪ মাস ১২ দিনের দিন) ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’-এর তৎকালীন মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র ‘বঙ্গবন্ধু’র গলায় ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি ‘বিশ্ববন্ধু’ও বটে।’ ওই একই মহতী সভাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানও উপস্থিত শান্তির সৈনিক আর কূটনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন: ‘লাখো শহিদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে প্রথম এশীয় শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য আগত শান্তির সেনানীদের জানাই স্বাগতম। উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিরোধ করে ত্রিশ লক্ষ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তিও অপরিহার্যতা।
এই পটভূমিতে আপনারা-বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন। এই সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্বশান্তি পরিষদ যেমন আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, এদেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন। আমি নিজে ১৯৫২ সালে পিকিং-এ অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় শান্তি সম্মেলনের একজন প্রতিনিধি ছিলাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের ১৯৫৬ সালের স্টকহোম সম্মেলনেও আমি যোগ দিয়েছিলাম। একই সাথে এটাও আমি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্বশান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোন স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসী নীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা তথা অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে আজ এক সঙ্কটজনক অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।
আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্ববাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি। শুধু সরকারের নীতিই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি সুদৃঢ় করা আমাদের সংবিধানের অন্যতম অনুশাসন। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমাদের সংবিধান জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি স্তম্ভের উপরই রচিত। এই আদর্শের ভিত্তিইে আমরা একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চাই।
আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আলোকেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য আমরা অনুধাবন করেছি। আমরা জানি, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সেজন্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, এ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনিবিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠন সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্র, নিরস্ত্রীকরণ ও মানব কল্যাণের যে কোন মহৎ প্রচেষ্টাকে।
বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণ আমাদের অন্যতম মূলনীতি হওয়ার জন্যই শুরু থেকে আমরা এই উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তির জন্য চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের বৈরী মনোভাবের দরুন আমাদের প্রচেষ্টা ফলবতি হয়নি। পাকিস্তান বার বার উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এসেছে। স্থায়ী শান্তি ও মানব কল্যাণে আমাদের উদ্যোগের সর্বশেষ প্রমাণ ১৭ই এপ্রিলে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণা। এই ঘোষণায় স্থায়ী প্রতিষ্ঠার সূত্র খুঁজে বের করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবে অনুকূল সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বেআইনিভাবে আটক নিরাপরাধ বাঙালিদের বন্দীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এইভাবে পাকিস্তানের একগুঁয়ে নীতি উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ আবার নতুন করে পাকিস্তানকে সজ্জিত করে চলেছেন নতুন নতুন সমরাস্ত্রে। নিঃসন্দেহে এটা স্থায়ী শান্তির যে কোন শুভ উদ্যোগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। আমি-এর প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জয় বাংলা। জয় বিশ্বশান্তি” (তথ্যসূত্র: এশীয় শান্তি সম্মেলনের পক্ষ থেকে প্রচারিত পুস্তিকা, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০, ঢাকা)।
সে সময় শেখ মুজিবের ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক গ্রহণের ফলে পরিণত হয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’তে, যা তাঁর ও বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বিরাট সম্মান এবং গর্বের বিষয়। ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি। বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে যারা এ বিরল সম্মান ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু (১৮৮৯-১৯৬৪), ভিয়েতনামের জাতীয় নেতা হো চি মিন (১৮৯০-১৯৬৯), মার্কিন বর্ণবাদবিরোধী নেতা মার্টিন লুথার কিং (১৮৯৯-১৯৮৪), চিলির কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩)। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ (১৯০৬-১৯৮২), চিলির প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দে (১৯০৮-১৯৭৩), আলবেনীয়ার রোমানীয় ক্যাথলিক নান মাদার তেরেসা (১৯১০-১৯৯৭), ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি (১৯১৭-১৯৮৪), দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা ও প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩), কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো (১৯২৬-২০১৬), প্যালেস্টাইন নেতা ইয়াসির আরাফাত (১৯২৯-২০০৪) প্রমুখ।
বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দম্পতি মাদাম কুরি ও পিয়েরে কুরি ছিলেন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় এক্স-রে সংকট দেখা দিলে নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রায় ১০ লাখ মানুষকে এক্স-রে সেবা দেন এই দম্পতি। বিশ্বশান্তির সংগ্রামে এই বিজ্ঞানী দম্পতির অবদান অপরিসীম। এই দম্পতির অবদানকে যুগ থেকে যুগান্তর চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ ফ্যাসিবাদবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে এবং মানবতার কল্যাণে শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে ১৯৫০ সাল থেকে শান্তি পদক দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু এই দম্পতির কন্যা ইরেন কুরি বিয়ে করেন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিওকে। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক ও ইরেন উভয়ে উভয়ের পদবি গ্রহণ করেন এবং একজনের নাম হয় জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি এবং অন্যজনের নাম ইরেন জুলিও কুরি। তাঁরা দু’জনেও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ ১৯৫৯ সাল থেকে তাদের শান্তি পদকের নামের আগে যুক্ত করেন ‘জুলিও কুরি’। সেই থেকে বিশ্বশান্তি পরিষদের পদকটি ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক নাম আজও পরিচিত।
সেই সময় বিশ্বশান্তি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বশান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান আর ‘বিশ্ববন্ধু’ উপাধি ছিল এক বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর এই পদক লাভে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দ্বিতীয়বারের মত মর্যাদায় উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে শ্রী রমেশ চন্দ্র ভুল কিছু বলেননি আর ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবও তার প্রমাণ রেখেছিলেন তাঁরই শাসনামলে জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সারা জীবনে কখনও কোনো ধরনের আপোস ব্যতীতই বাস্তবে রূপান্তরের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনিই জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশি স্থায়ী মিশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট শুক্রবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে, বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায়; কূটনীতিকরা অত্যাচারিত মানুষদের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রাম ও অবদানের জন্য তাকে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আজ তাঁর অবদান শুধু বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সীমায়িত নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবদান অপরিসীম ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একজন অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় নেতা। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের যে সম্মান ও অর্জন, তা বিশ্বের খুব কম দেশেরই রয়েছে। তাই আজ ‘বিশ্ববন্ধু’ বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির কন্ঠস্বর।
আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তিনি দিন-রাত মাঠে-ঘাটে রাজনীতির সাধারণ কর্মী থেকে ধাপে ধাপে রূপান্তরিত হন ‘মুজিব’ থেকে ‘শেখ মুজিব’, ‘শেখ মুজিব’ থেকে ‘শেখ সাব’ (১৯৪০-৬৭ সাল), ‘শেখ সাব’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ (১৯৬৭-৬৯ সাল), ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘জাতির জনক’ (১৯৭১ সাল) আর ‘জাতির জনক’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’ (১৯৭৩ সাল)-এ। তিনি ‘মুজিব’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’ (১৯৪০-৭৩ সাল)-তে রূপান্তরিত হতে সম্ভাব্য যত ধরনের মেধা ও মনন-ধীশক্তি-শ্রম ব্যয় করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি এবং ভিন্নমাত্রার মেধা-মনন ধীশক্তি-শ্রম ব্যয় করেছেন জনযুদ্ধের পরের মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ-শোষণমুক্ত-বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ আলোকিত এক রাষ্ট্র-সমাজ বিনির্মাণে। যার জন্য তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র ১৩১৪ দিন। তাঁর জীবন যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত, মাত্র ৫৫ বছরের (১৯২০-১৯৭৫)। এর মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন ৩৫ বছর।
সমকালীন ইতিহাসে জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বিশ্বের আত্মমর্যাদাশীল এক মহান নেতা। আজ তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নয় বিশ্বমানচিত্রে এক অনন্য ইতিহাস। তিনি চিরঞ্জীব-পৃথিবীর অগণিত জনমানুষের হৃদয়ে আর ইতিহাসের পাতায়, যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকবেন। তিনি আজ শুধু বাংলাদেশের জনমানুষেরই নন, বিশ্বের সকল স্বাধীনচেতা মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষের স্বজন। ইতিহাস ও জনমানুষের মন থেকে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিবের কীর্তি শত চেষ্টা করেও আর কোনোভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। কারণ-তিনি গড়তে চেয়েছিলেন সুস্থ-সবল-জ্ঞানসমৃদ্ধ-ভেদ-বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আলোকিত মানুষের জন্য জনকল্যাণমূখী উন্নত এক বাংলাদেশ। তাঁর ছিল জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির উপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা ও মমত্ববোধসহ সহমর্মিতা। এছাড়া- জনগণের স্বার্থ বিশেষত দরিদ্র মেহনতি মানুষেরস্বার্থ ছিল তাঁর কাছে সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
যার কারণেই দেশের অগণিত জনমানুষ জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সাহস সংগ্রাম ও নেতৃত্বেই ৬-দফা থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁর নামেই সরকার গঠন, যুদ্ধ পরিচালনাসহ অন্যান্য সকল কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হয়েছে। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষা, সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তিনি এই পরীক্ষায় দারুণ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সে সময় তাঁর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয় এক অনন্য ভাষণ। ইতিহাসের পাতায় শতাব্দীর পর শতাব্দী শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ওটা চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাই আজ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির জনক ‘বিশ্ববন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, যাঁর কাছে শুধু বাংলাদেশের জনমানুষই নয়, আজন্ম ঋণ বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের। এখন গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ও আত্মবিশ্বাসে ‘বিশ্ববন্ধু’ দেশ এবং দেশান্তরে আর যুগান্তরে আজন্মের প্রেরণার উৎস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)