জাতীয় গার্মেন্টেস শ্রমিক ফেডারেশনের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ একই সূত্রে গাঁথছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে পোশাক খাত নিয়ে এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র।
গত রোববার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা ঘোষণার দাবি জানায় জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। এসব দাবি আদায়ে মিছিল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রাসহ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে সংগঠনটি। সমাবেশে শ্রমিক নেতারা জানান, ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ৮ হাজার টাকা মজুরি ছিল ওই সময়ের ১০০ ডলারের সমান। বর্তমানে ১০০ ডলারের বাজারদর দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার টাকার বেশি। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে দেশে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করলে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত।
নেতারা আরও বলেন, পোশাক কারখানার মালিকদের মুনাফা ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া মালিকরা রপ্তানির বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনাও পান। এ বিষয়গুলোও মজুরি নির্ধারণে আমলে নেওয়া দরকার। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। পাশাপশি ৬৫ শতাংশ মূল মজুরি ও প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির দাবি করে সংগঠনটি। তাদের দাবির পক্ষে পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতাদেরও সহযোগিতাও চান শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিকদের এই দাবি নিয়ে কথা বলেন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান । তিনি বলেন, গত চার বছরে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়নি এটা ঠিক নয়। সর্বশেষ মজুরি বোর্ড বেতন বাড়ানোর পর প্রতি বছরই তাদের শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে। তারা এখন বেতন বাড়ানোর দাবি করছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অবশ্যই মালিকরা মজুরি বাড়াবে। তবে তা সক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে। পাশাপাশি ভাবতে হবে সদ্য করোনা পরবর্তী পরিস্থিতির কথা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জানান, পোশাক খাতে ২০১৩ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ২০১০ সালে ৩০০০ টাকা ছিল, ২০০৬ সালে এটি ছিল ১৬৬২ দশমিক ৫০ টাকা, ১৯৯৪ সালে ৯৪০ টাকা এবং ১৯৮৫ সালে ছিল ৬২৭ টাকা। সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে গার্মেন্টস খাত।
আগামী নভেম্বরের আগেই শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্য রয়েছে মজুরি বোর্ডের। বেশিরভাগ পোশাক কারখানার মালিক মজুরি বাড়ানোর পক্ষে। তারা বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সার্বিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে ন্যূনতম মজুরি ১২ থেকে ১৩ হাজারের বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। এরই মধ্যে নিম্নতম মজুরি নিয়ে বোর্ডের দু’টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করতে হয়। সে হিসেবে এবছরই বাড়ছে মজুরি। এখন মজুরি নিয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করলে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গার্মেন্টেস মালিকরা আরও জানান, ২০১৯ সাল থেকে গার্মেন্টস এর ন্যূনতম মজুরি ৮০০০ পাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। এই খাতে বর্তমানে মজুরি প্রথম গ্রেডে ১৮ হাজার ২৫৭, দ্বিতীয় গ্রেডে ১৫ হাজার ৪১৬, তৃতীয় গ্রেডে ৯ হাজার ৮৪৫, চতুর্থ গ্রেডে ৯ হাজার ৩৪৭ ও পঞ্চম গ্রেডে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা। বেসরকারি খাতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটের বেতন শুরু হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেলস রিপ্রেসেন্টিটিভরা পান ১০ হাজার টাকা। এমনকি সরকারি চাকরির অনেক ক্ষেত্রে মূল বেতন এর চাইতে কম। তাছাড়া পোশাক খাতে চাকরিতে ঢোকার জন্য কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার দরকার হচ্ছে না। সে হিসেবে মজুরি বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক হলেও ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিটি অযৌক্তিক।
এইদিকে এবছর যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ এনেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বিজিএমইএ তাদের অধীনে থাকা কারখানা থেকে নকল পণ্য রপ্তানির এই অভিযোগ নাকচ করেছে। তাদের মতে, নকল তৈরি পোশাক রপ্তানি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেনি অভিযোগকারী সংস্থাগুলো । তারা আরও জানায় ব্র্যান্ডগুলো থেকে নকল পণ্য রপ্তানির যে অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো আসলে অনুমান নির্ভর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও নকল তৈরি পোশাক রপ্তানির এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। তারা বলছেন, ২০১৮ সালে ঘোষিত নতুন মজুরি দেয়ার আগে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া নতুন মজুরি সন্তোষজনক ছিল। বাংলাদেশ সরকার রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য অটোমেশনের সাথে সামঞ্জস্য করতে আরএমজি সেক্টরকে সহায়তা করছে। বাংলাদেশ সরকার হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টারএকশ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০ লাখ আরএমজি কর্মীর জন্য প্রোগ্রাম চালু করেছে। দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ১৫ লাখ আরএমজি কর্মীর জন্য প্রোগ্রাম চালু করেছে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে সরকার।
তারা আরও জানান, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ মিলিয়ে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্যে তৈরি হয়েছে একটি বিশাল ক্ষেত্র। প্রত্যেকটি কারখানায় পেশাগত নিরাপত্তা কমিটি রয়েছে, যেখানে শ্রমিক ও কর্মচারীরা একসাথে কাজ করছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০টি শীর্ষ স্থানীয় পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৮টিই এখন বাংলাদেশে। বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে লিড সনদপ্রাপ্ত ২০০ পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মধ্যে ৭৩টি লিড প্লাটিনাম, ১১৩টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও ৪টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্রখাতে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ২০০ তে উন্নীত হয়েছে।
আর বিজিএমইএর নির্বাচিত একজন কর্মকর্তা বলছেন, নির্বাচনের আগে গার্মেন্টস সেক্টরকে অস্থিতিশীল করা, শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করা এবং বাংলাদেশি পণ্যের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ তোলা একই চক্রের ষড়যন্ত্র। তারা চায় বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত অস্থিতিশীল হোক। কারণ ষড়যন্ত্রীরা মনে করে গার্মেন্টস খাত অস্থিতিশীল হলে সরকার চাপে পড়বে।