বিশ বছর ধরে তারা লেগে ছিল মামলাটির পেছনে। ভারতের রাজস্থানের যোধপুরের আদালতে যখন সালমান খানের সাজা হয়, আদালতের বাইরে সেসময় উল্লাস করে মিষ্টি বিতরণ করেছে একদল মানুষ। যারা ভারতের বর্ণিল সংস্কৃতির মরুরাজ্য ‘আজমীর শরীফ’ খ্যাত রাজস্থানের ‘বিশনয়’ সম্প্রদায়।
পবিত্র গাছ এবং প্রাণীর জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত বিশনয় সম্প্রদায়। নিরামিষভোজী বিশনয়দের কাছে গাছ কাটা এবং প্রাণী হত্যা মহাপাপ। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, ১৭৩০ সালে যোধপুরের রাজা নিজের প্রাসাদ তৈরীতে খেজরী গাছ কাটার নির্দেশ দিলে বিশনয় নারী অমৃতা দেবী এবং তার তিন মেয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে। রাজার সৈন্যরা তাদের হত্যা করে। গাছ বাঁচাতে গিয়ে শতাধিক বিশনয় নারী-পুরুষ এবং শিশু হত্যার শিকার হন। এ ঘটনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উত্তরাখন্ডে গড়ে উঠে চিপক বন বাঁচাও আন্দোলন। বিশনয়রা জ্বালানি হিসেবে গাছ কাটেনা। পড়ে থাকা পাতা বা ভেঙ্গে যাওয়া শাখা তারা ব্যবহার করে। এতিম বাছুরকে তারা নিজেদের সন্তানের মত পালন করে।
বিকানরের গুরু জম্বেশ্বর ভক্তি এবং পরম্পরা সাধারণ বিশনয় সম্প্রদায়কে বলিউড মেগাস্টার সালমান খানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যে সম্প্রদায়ের এক যুবক পুনমচাঁদ বিশনয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসে দেখেছিলেন তাদের দেবতা কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার ঘটনা। তার দাবী ছিল, সালমান খান এবং তার সহযোগীরা রাজস্থানের যোধপুরের প্রত্যন্ত ভাগোদা ধানীর কংকানি গ্রামে দুটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করে পালিয়ে যাচ্ছে। পুনমচাঁদ তার অভিযোগে বলেন, তিনি গুলির শব্দ শোনেন। দেখেন একটি জিপ গাড়ির জ্বলে থাকা হেডলাইট। সেই আলোতে জিপের সামনের আসনে সালমান খান এবং সাইফ আলী খানকে দেখেন। আর পেছনের আসনে বসা দেখেন নায়িকা টাবু, নিলম এবং সোনালী বেন্দ্রেকে। অভিযোগে তিনি আরো জানান, তিনি শুনতে সালমানকে তার সহ অভিনেতা গুলি করতে বলছে আর তিনি তা পালন করছেন। তিনি চিৎকার করে উঠলে সালমান খান গাড়িসহ পালিয়ে যান। পরে তার জীপের নম্বর পুলিশকে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ জানায় তার জীপে পাওয়া রক্তের নমুনা কৃষ্ণসার হরিণের রক্তের নমুনার সঙ্গে মিলেছিল।
১৯৯৮ সালের অক্টোবরে এই সম্প্রদায়ের মানুষ সালমান খান সহ একটি শুটিং ইউনিটের আরো কজনের বিরুদ্ধে দুটি কৃষ্ণসার হরিণ যা চিংকার নামেও পরিচিত – হত্যার অভিযোগে মামলা করে।
চিংকার হরিণ ভারতে সংরক্ষিত প্রাণীর তালিকায়। সে কারণে, সাথে সাথেই সালমানকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যদিও ১০ দিন পর তিনি জামিনে ছাড়া পান। ২০ বছর তাড়িয়ে বেড়ানো মামলায় সালমান খানের পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে। এর মাঝে ফুটপাতে গাড়ি উঠিয়ে মানুষ হত্যার মামলায় তিনি রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু দুটি হরিণ শিকারের মামলা তাকে ছাড়েনি।
এর প্রধান কারণ বিশনয় সম্প্রদায় এই মামলা থেকে সরে যায়নি কখনও। প্রায় পাঁচশত বছর ধরে তাদের ধর্মীয় ভগবান বিষ্ণুর পূজারি বিশনয় সম্প্রদায় ২৯টি রীতি অক্ষরে অক্ষরে মানার চেষ্টা করে। আর সেই সব রীতির মূল বার্তা কথা – প্রকৃতির সুরক্ষা, বৃক্ষ রক্ষা ও জঙ্গলের প্রাণী রক্ষা। চিপকের বনরক্ষা আন্দোলনও তাদের মামলায় একাগ্র হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
চিংকার হরিণকে বিশনয় সম্প্রদায় পবিত্র হিসাবে গণ্য করে। এই হরিণকে তারা বলতে গেলে পুজো করে। প্রাচীন হিন্দু পুরানের এই কৃষ্ণ হরিণের উল্লেখ রয়েছে যে এরা ভগবান কৃষ্ণের রথ টানতো। চিংকারকে মানা হয় বাতাস এবং চাঁদের বাহন হিসাবেও। বিশ্বাস এবং ভক্তির কারণেই প্রভাবশালী বিশনয় সম্প্রদায় ২০ বছরেও এই মামলা নিয়ে হাল ছাড়েনি। সাথে ছিল প্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণের আন্দোলনকারীদের সাহায্য।
সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকলেও ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালে এই হরিণ দেখা যায়। ভারতের রাজস্থান এবং গুজরাটের মরু এলাকায় এগুলো চেখে পড়ে বেশি।
পুরুষ চিংকারের ওজন বড় জোর ৪৫ কেজি। উচ্চতা ৭৪-৮৮ সেমি। মাদি চিংকার অপেক্ষাকৃত ছোট। চিংকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য মৌসুম বদলের সাথে এটি রং বদলায়। বর্ষার শেষে পুরুষ চিংকারের রং থাকে কালো। কিন্তু শীতের সাথে সাথে রং হালকা হতে হতে এপ্রিল নাগাদ বাদামি হয়ে যায়। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আরাফ তাহসিন বিবিসিকে জানিয়েছেন, এমনকি ব্রিটিশ শাসনকালেও উদয়পুরে ঝাঁকে ঝাঁকে চিংকার দেখ যেত, কিন্তু এখন সেই দৃশ্য বিরল। তার মতে, এরা ঘন জঙ্গলের প্রাণী নয়, সমতলে খোলা জায়গা এদের পছন্দ। যেহেতু এ ধরণের জায়গা দ্রুত মানুষের দখলে চলে যাচ্ছে, ফলে এরা বিপদে পড়েছে”।
জানা যায়, দুশ বছর আগে যেখানে ভারতে এই হরিণের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখের মত, ২০১০ সালে সেটি নেমে আসে মাত্র ৫০হাজারে । ফলে, চিংকার শিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভারতে।