মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দিনগুলোতে যখনই সময় পেতাম চারুকলার জয়নুল আর্ট গ্যালারির যাবতীয় প্রদর্শনী দেখতাম, নাট্যকলা এবং সঙ্গীত বিভাগের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও অনুষ্ঠান কখনো বাদ পড়েনি।
পড়ালেখার পাশাপাশি টি এস সি ‘ র আবৃত্তি কর্মশালা, বিতর্ক শিল্প চর্চা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড , পথনাটক, বেইলি রোড/ শিল্পকলার মঞ্চ নাটক,জাতীয় জাদুঘরের এবং বেঙ্গল আর্ট গ্যালেরির বিভিন্ন প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখা , জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ এর মোটামুটি সকল প্রদর্শনী গলাধঃকরণ করা, ইন্ডিয়ান হাই কমিশন এর ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত , নৃত্য , বাদ্যযন্ত্রর কনসার্ট টিকেট পাবার জন্য কি প্রানান্ত চেষ্টা, ব্রিটিশ কাউন্সিল এর নানা ওয়ার্কশপ, সেমিনার, Alliance Française বা ধানমন্ডির দৃক গ্যালারির ফোটোগ্রাফি প্রদর্শন গুলো দেখতে দেখতে মন ও মননশীলতায় শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখেছি প্রথমত । আর বুঝতে শিখেছি শুধু টেলিভিশনে বা মঞ্চে গান, নাচ আর অভিনয় করে টাকা কামালেই মানুষ শিল্পী হয় না । প্রতিটি সৃজনশীল মানুষই একজন শিল্পী প্রথমে মনের ভেতরের শিল্পটাকে তৈরী করতে না পারলে শিল্পী হওয়া যায় না। ইমোশনাল, ইন্টেলেকচুয়াল এবং স্পিরিচুয়াল জ্ঞানটাকে আরাম করে ভেতরে নেয়া যায় এইসকল শৈল্পিক ইনস্ট্রুমেন্ট গুলো দিয়েই।
আমার নিজের জীবনের এই সহজ উপলব্ধি ও কথাগুলো কোনোদিন কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে ভাবিনি । চারিদিকে এত ফ্যাশনেবল জামাকাপড় পড়া,লেখাপড়া জানা, বড়ো চাকরি করা , ডিগ্রির ভারে জর্জরিত লোকজন দেখি কিন্তু শৈল্পিক মনের, মুক্ত মনের, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল জ্ঞানের চর্চা করা সেই মানুষ গুলোকে আর দেখিনা । সবাই শুধু জাগতিক পোশাকি, আরাম আয়েশ, অবাস্তব বিরক্তিকর হিন্দি ছবি / সিরিয়েল এর মতো আভিজাত্য প্রদর্শন নিয়ে ব্যস্ত । শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পী পদ্মশ্রী লীলা স্যামসন এর নৃত্য (মনে পড়ে আজও তার পারফরমেন্স দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯৭ -৯৮ এ ঢাকার ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার এ ), কমলা রানীর সাগর দীঘি আজ আর মানুষ সময় নিয়ে দেখতে চায় না, ময়মনসিংহ গীতিকা, খনা’র অন্তর্নিহিত জ্ঞানগুলো উপলব্ধি করতে চায় না । অবাক হয়ে দেখি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলেরা কেমন করে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলায় গেলে তাদের ইন্টেগ্রেশনে সমস্যা হয় ! আমি অনেক তরুণদের জানি যারা উপরেল্লিখিত শিল্পাঙ্গনে জীবনে পা না রেখেই (দর্শক হিসেবে বা শিল্পমনা মানুষ হিসেবে) বড়ো বড়ো ডিগ্রী ধারী হয়ে গেছে । এইসকল ডিগ্রিধারী মূর্খগুলো (যাদের অন্তরাত্মার বিকাশ ঘটেনি) বিদেশে এসেও শিল্প সাহিত্য চর্চা, খেলাধুলা চর্চার ক্ষেত্রগুলোকে পাশকাটিয়ে গিয়ে মনোযোগ দিয়েছে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা, হাপুস হুপুস করে গিলে শেষ করেই একটি চাকরি বাগিয়ে,প্রয়োজনীয় -অপ্রয়োজনীয় জাগতিক বাড়ি -গাড়ি কিনে,তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই তথাকথিত গদবাঁধা প্রফেশনাল হতে পারার স্কুলে পড়িয়ে, সুখ করে ঢেকুর তুলে না বুঝে ধর্ম -কর্ম করে, স্বর্গ বুকিং দিয়ে, চাতকের মতো পটল তুলতে রেডি হয়ে আছে । আমার দেখা মতে,শিল্প বিহীন, বেড়ে উঠা মানুষগুলোর ধর্ম আত্মায় বসবাস করে না, তাদের ধর্ম বসবাস করে কেবল আকাশে সাত আসমানের নিচে।
হোলিস্টিক জ্ঞানটা আসে ইন্টারডিসিপ্লিনারি ফর্মাল এবং ইনফরমাল এডুকেশন থেকে, এই কথাটা আর কেমন করে বললে মানুষ বুঝবে আমার সত্যি জানা নেই । সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাংলাদেশের হাতে গোনা কিছু পাবলিক এবং কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় না পর্যন্ত । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এম বি এ, কম্পিউটার সায়েন্স, ফ্যাশন ডিজাইন, আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিকেলে পড়ার হিড়িক শিক্ষার্থীদের মধ্যে । কারণ সহজে চাকরি পাবে, টাকা কমাবে বেশী।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ইতিহাস, দর্শন, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি , আইন, মনোবিজ্ঞান, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, সোশ্যাল জাস্টিস স্টাডিজ, রিলিজিয়ন অ্যান্ড কালচার, সংগীত, নাট্যতত্ত্ব, চারুকলা এবং বাংলা/ ইংরেজি সাহিত্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো সবচেয়ে নিগৃহীত এবং পরিবার উৎসাহ যোগায় না পড়বার জন্য, চাকরি পাবে না বলে। বর্তমান বাংলাদেশের জন্য ক্রিটিক্যাল থিংকিং, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী শিক্ষা, ‘ডিকলোনাইজেশন অফ থটস’ ভীষণ জরুরি যা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষদের চিন্তাকে উগ্রবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। কিন্তু পুঁজিবাদী কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড যেভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে সেখানে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে . স্কুল কলেজ এ সাইন্স, কমার্স, এবং ম্যাথ টিচার এর ভীষণ প্রতাপ । সমাজ বিজ্ঞান, বাংলা সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, অংকন ও চিত্রায়ন টিচার এর যে কতটা করুন হাল তা না হয় আর নতুন করে নাইবা বললাম।
শিল্পকলার ইতিহাস, শিল্পমাধ্যম ও শিল্পের নন্দনতত্ত্ব, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস , ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাংলাদেশের সংবিধান, অর্থনীতি, আইন, সমাজ ব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং নৈতিক জ্ঞান ছাড়া বেড়ে উঠলে সে জাতি অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। আজকের বাংলাদেশকে নিয়ে আমি একেবারেই বিস্মিত নই তবে উদ্বিগ্ন ।
সত্যিকার ধর্ম প্রাণ পরিশীলত আত্মার মানুষও আজ আর দেখিনা কারণ ধর্মের সেই নিগূঢ় অন্তর্নিহিত অর্থটাও মানুষ আজ নিতে পারছে না কারণ সেই উপলব্ধিকে মানুষের মাঝে তুলে দেবার বাহন গুলো হলো এই সৃষ্টিশীল শিল্পাঙ্গন । যেগুলোকে উপেক্ষা করে এই প্রজন্ম লিক লিক করে বেড়ে উঠছে ইটের দ্বারা চাপা পড়া সাদা হয়ে থাকা ঘাসের মতো । চাপা পড়া ঘাস রোদ, আলো, বাতাস ছাড়া বেঁচে থাকা, দেখতে হয় সাদা , সবুজ সতেজ ঘাস আর এই ইট দিয়ে চাপা পড়া সাদা ঘাস দুটোই কিন্তু ঘাস , এতে কোনো সন্দেহ নেই ! মানবিক মূল্যবোধ ও চেতনা নিয়ে জাগ্রত সেই মানুষদের, সেইসকল শিক্ষার্থীদের আজ আর দেখতে পাই না ।
সমাজের সৃষ্টিশীল মাধ্যমগুলো ( লেখক, কবি , সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিত্রকর, ভাস্কর, ফটোগ্রাফার, সংগীতজ্ঞ, সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয় শিল্পী , ক্লাসিকাল চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারী নির্মাতা, সোশ্যাল ও এডুকেশন রিফর্মার ) নিয়ে যারা কাজ করে তাদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলে অনেক মূর্খ প্রফেশনালস । শিল্পীদের সাদামাটা সৃজনশীল যাপিত জীবন, তাদের সৃষ্টিকে অবমূল্যায়ন করা এবং কর্ম যজ্ঞের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া নিয়ে যারা মগ্ন তাদেরকে বলি—- স্কুল, কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে হুজুর -মোল্লা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকুরীজীবি শিক্ষক , আইনজীবী বানানো যায় কিন্তু সেইসকল তথাকথিত “সুপার নোভা ” সামাজিক প্রফেশনালদের (বিশেষ করে টেকনোক্রাটদের বলছি ) চাইলেই শিল্পী, সাহিত্যিক, ফিলানথ্রপিস্ট আর সৃজনশীল চিন্তাশীল স্কলার বানানো যায় না ! কিন্তু একজন সৃজনশীল শিল্পী চাইলেই উপরেল্লিখিত যেকোনো ক্ষেত্রে প্রফেশনাল হতে পারে সমান সুযোগ -সুবিধা পেলে !
একটি কথা শুনেছিলাম বাবার মুখে আইনস্টাইন কখনো সেক্সপিয়ার হতে পারবেনা কিন্তু সেক্সপিয়ার কে একজন আইনস্টাইন বানানো সম্ভব । সেই কথাটিকে আজও উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছি তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আরো একটু যোগ করে বলতাম বাবা ঠিক বলেছ সবাই চাইলেই ওলস্টোনক্রাফট, বেভোয়ার, স্পিভাক, বন্দনা শিবা, ফ্রিদা আর রোকেয়াও হতে পারে না, সামাজিক বিপ্লব ঘটানো মানুষগুলোকেও আমার সেক্সপিয়ার এর মতো সৃজনশীল মনে হয় । পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শিখিয়েছে টাকা কামাও আর যন্ত্রের মতো সমাজে সেবা দাও টেকনোক্র্যাট হয়ে । যার কারণে সেই সৃজনশীল জ্ঞানের চর্চা কমে গেছে , মানবিক জ্ঞানের চর্চা কমে গেছে । মার্কস, ম্যাক্স ওয়েবার, বার্টান্ড রাসেল, প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল , সক্রেটিস, অগাস্ট কোৎ, ভ্যান গঘ , পাউলো ফ্রেইরি, জন ডেউয়ে, মিশেল ফুকো, ফ্রয়েড, মোজার্ট, বিটোভেন কে জানবার এবং বোঝার মাধ্যমগুলো কেমন যেন ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । চারিপাশের মানুষ জন সবাই কেমন যেন ফাঁপা মানুষ হয়ে বেড়ে উঠছে ।
সব কথার শেষ কথা, সবাই চাইলেই শিল্পী, সাহিত্যিক, ফিলানথ্রপিস্ট হতে পারে না । মনের ভেতরের শিল্প চর্চা করতে হলে, ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা শিল্পীকে বা সৃজনশীল মানুষটিকে জাগ্রত করতে হলে, চাই জন্ম থেকে নিয়ে আসা দুষ্প্রাপ্য কিছু সুপ্ত প্রতিভা এবং তার আমরণ সাধনা । চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মূল্যবান জ্ঞানগুলোকে উপেক্ষা করে, পৃথিবীর জ্ঞানী মনীষীদের রেখে যাওয়া মূল্যবান জ্ঞানও আজ আমাদের কাছে তুচ্ছ এবং সেগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখবার ক্ষমতাও আমাদের নেই । এ কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের বসবাস ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় দেখেছি দর্শন ছিল সবচেয়ে গর্হিত একটি ডিপার্টমেন্ট । যারা পড়তো সেখানে খুব নিচু চোখে দেখা হতো , মেধার দিক থেকে খুব নিম্ন মানের মনে করা হতো সেই সকল শিক্ষার্থীদের । কিন্তু দর্শন হলো পৃথিবীতে সবচয়ে ওজনদার একটি বিষয় ! হায়রে মূর্খ জাতি ! জ্ঞানের জগতে বৈষম্য ঢুকিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদীদের, সাম্রাজ্যবাদীদের মুনাফা হয়েছে সে বেশ বুঝতে পারি কিন্তু মানব মনের বিকাশের জন্য অপরিহার্য জ্ঞানের জগৎকে হেয় করে, জ্ঞান তৈরির কারখানা- মানুষের সৃজনশীল মনকে যন্ত্র বানিয়ে দেবার সংস্কৃতি তৈরী করে সারা পৃথিবীতে নলেজ প্রোডাকশন সিস্টেম এর যে ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে নানা উপায়ে পৃথিবী তার খেসারত দেবে একদিন। সেই খেসারত দেয়া শুরু হয়ে গেছে যদিও । এই ধস থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে কলা, সামাজিক বিজ্ঞানের জ্ঞানগুলোকে বাঁচাবার জন্য সচেতন আত্মাদের একসাথে হতেই হবে । জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশ ব্যতিরেকে মানব সভ্যতা ধ্বংস হতে বাধ্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)