আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ১৮ জনের ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ মঙ্গলবার ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রার্থীদের হলফনামা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করেছে টিআইবি। টিআইবির তৈরি করা নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র তুলে ধরেন এই গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
পাশাপাশি জনগণের জানার জন্য টিআইবি ‘হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি’ শীর্ষক একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করেছে। এই ড্যাশবোর্ডে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় ছয় হাজার হলফনামার আটটি তথ্যের বহুমাত্রিক-তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই ইন্টারঅ্যাকটিভ ড্যাশবোর্ড থেকে ঘরে বসেই ভোটাররা নিজ এলাকার প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।
তথ্যচিত্র অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে ১৮ প্রার্থীর ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) আছে, তাদের মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত। ৮ জন স্বতন্ত্র। এই ১৮ জনের মধ্যে সবার ওপরে আছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি বর্তমানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, তার সম্পদের (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে) মূল্য ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকার বেশি।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। ১৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ ভাগ। ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির ভূমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ১০০ বিঘা পর্যন্ত। তথ্যচিত্রে বলা হয়, হলফনামা অনুযায়ী, অনেক প্রার্থীর নামেই বড় আকারের ভূমির মালিকানা রয়েছে।
এবারের নির্বাচনেও নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ খুব কম। এই হার মাত্র ৫ দশমিক ১০। অন্যদিকে, পুরুষ প্রার্থী ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এবারের প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ ব্যবসায়ী (মূল পেশা বিবেচনায়)। অন্যদিকে, রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রার্থী। টিআইবি বলছে, হলফনামায় দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব তথ্য যাচাই করা যাদের দায়িত্ব, তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন এই কাজটি করতে পারে। কিন্তু কেউই তা করে না। এখানে দায়সারাভাবে তথ্য দেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়।
টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু হলফনামায় তা দেখা যায়নি। এই মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল স্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মূল্য ২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এই মন্ত্রী তার হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি।
উল্লিখিত মন্ত্রীর নাম জানতেই চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু তথ্য গোপনের ব্যাপার রয়েছে এবং তিনি (মন্ত্রী) নিজে তা প্রকাশ করেননি, তাই টিআইবি তার নাম প্রকাশ করছে না। তবে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ যদি টিআইবির কাছে জানতে চায়, তাহলে তারা তথ্য-প্রমাণসহ তা দেবেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলফনামার তথ্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও উদ্বেগজনক। প্রার্থীদের হলফনামা দেখে ভোটার যদি মনে করেন, তিনি এই প্রার্থীকে ভোট দেবেন না, কিন্তু এই যে ভোট দেবেন না, সেই বিকল্প প্রার্থী তার সামনে নেই। জনগণের যে বিচারের ক্ষমতা ছিল, সেই বিচারের ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, সমাজে দুটো শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। এক শ্রেণি অতি সম্পদশালী, আরেক শ্রেণি দিন-আনে দিন খায়। অল্প কিছু লোকের আগ্রাসী সংস্কৃতির মধ্যে চলে গেছে দেশ। এটা বিপজ্জনক।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলমসহ প্রমুখ।