বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ড্রাইভিং স্কুলে সফল প্রশিক্ষণ শেষে পেশাদার চালকের আসনে বসতে প্রস্তুত এমন ১১ জন নারীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ তুলে দেয়া হয়েছে। এই নারীরা এখন দক্ষ, আত্মপ্রত্যয়ী। এটি সম্ভব হয়েছে তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের মানসম্মত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, এমনটাই জানালেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী চালকেরা।
বুধবার (২৬ জুলাই) সনদ বিতরণ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম।
ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক মো. মাইনুল হোসেন প্রতিষ্ঠানটির সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক এম খালিদ মাহমুদ। আয়োজকরা জানান এই ১১ জন নারী ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলে তিন মাসের নিবিড় আবাসিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধাসম্পন্ন এই গাড়িচালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে তারা গাড়িচালনা বিষয়ে তাত্ত্বিক ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এর পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের প্রশিক্ষণ এবং জেন্ডার ও সুরক্ষা (সেফগার্ডিং) বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণও লাভ করেছেন তারা। প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পরিচালিত পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়েছেন। এরপর ব্র্যাকের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জ্যেষ্ঠ গাড়িচালকদের অধীনে শিক্ষানবিশ পেশাদার গাড়িচালক হিসেবে আরও তিন মাস প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, গাড়ি চালনার পেশাটি সম্মানীয় হলেও আমরা এটাকে খুব বেশি সম্মান দেই না। যে কারণে অনেকে এই পেশায় আসতে চায় না। নারী গাড়িচালকদের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের ১০ শতাংশ কোটা আছে নারী গাড়িচালকদের জন্য। নারী যাত্রীদের জন্য আমাদের আলাদা বাস আছে, কিন্তু সেখানে মহিলা ড্রাইভার-হেল্পার নাই। বিআরটিসি বিভিন্ন জেলায় খণ্ডকালীন গাড়িচালক নিয়োগ দেয়। সেখানে নারী চালকরা যোগ দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন,এটা গুরুত্বপূর্ণ পেশা। অথচ আমরা পর্যাপ্ত সংখ্যক চালক তৈরি করতে পারছি না। ব্র্যাক যে মানসম্পন্ন গাড়িচালক তৈরি করছে অনেকে এ সম্পর্কে জানেও না। জানলে বহু জায়গা থেকে এদের জন্য চাকরির অফার আসতে পারত।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম পারিবারিক-সামাজিক বাধার কথা উল্লেখ করে বলেন, পরিবার ও সমাজ নারীদের এই পেশায় আসতে দিতে চায় না। গত বছর আমরা ১০০ চালক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম, সেখানে ১৫ জন নারী নিতে পারতাম। কিন্তু পরীক্ষা দিলো মাত্র একজন। তাকে কিন্তু আমরা নিয়েছি। এবার আমরা টেকনিশিয়ান নেব ২৭ জন। কিন্তু এসেছে মাত্র ৩ জন নারী। আবার নারীরা আসতে শুরু করলে দেখা যাবে সমাজের স্বীকৃতিও চলে এসেছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, একজন ব্যক্তির ১২ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে তিনি চালক হতে পারেন। সেখানে এই নারীরা সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং সড়কে বারোশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই প্রথম চেষ্টায় বিআরটিএর লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিন মাস আগে লাইসেন্স পেয়েছেন। গাড়িচালনা ছাড়াও এই চালকরা ইংরেজিতে যোগাযোগের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। জেন্ডার সচেতনতার প্রশিক্ষণও পেয়েছেন। প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারেন তারা। এরা খুবই প্রশিক্ষিত চালক । প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী গাড়িচালক মৌসুমী খাতুন বলেন, আমরা কেবল ড্রাইভিংই শিখি নাই। আরও অনেক কিছু শিখেছি। এমনকি আচার-আচরণও শিখেছি। খুব সুন্দরভাবে প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এখন আমরা গাড়ি চালানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন আমাদের একটা চাকরি দরকার।
সকল ধরনের ব্যবহারকারীর জন্য সড়কগুলোকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রাম ২০০১ সাল থেকে কাজ করে চলেছে। এসব কার্যক্রমের একটি বড় অংশ নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রদান। এ উদ্দেশ্যে এখন পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি সাধারণ সড়ক ব্যবহারকারী, ৫ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী এবং ৫ হাজার ৪ শত শিক্ষককে নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্র্যাক রোড সেফটি প্রোগ্রাম ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল পরিচালনা করছে। এই স্কুলে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ৫ শত ৩৫ জন বাণিজ্যিক গাড়িচালনা, ৮ হাজার ১ শত ৪৭ জনকে বুনিয়াদি গাড়ি চালনা, ২ হাজার ৬ শত ৯৮ জন নারীকে গাড়িচালনা, ২ হাজার ১৩ জনকে মোটরসাইকেল চালনা এবং ৩৮৪ জনকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।