ছোট্ট একটি হোটেলে ঢুকে দেখা গেল চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছেন লোকজন। খাবার পরিবেশনকারীরাও মহাব্যস্ত। খালি নেই কারও হাত। কেউ এসে দিচ্ছেন ভাত, কেউ দিচ্ছেন তরকারি। হোটেলজুড়ে জমজমাটভাবে চলছে সাহরি পর্ব।
রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌর শহরের কলেজ বাজারের কাঁচা মালপট্টিতে ‘রফিকের হোটেলে’ দেখা গেলো এমন চিত্র।
হোটেলটি তেমন একটা বড় নয়। মালিকও নয় তেমন অবস্থাশালী। কিন্তু তিনি বছরের ১১ মাস হোটেলের খাবার বিক্রির আয় দিয়ে পুরো বছর সংসার চালান। পাশাপাশি রমজান মাসের জন্য প্রতিদিন কিছু টাকা জমা রাখেন। ওই টাকা দিয়ে হোটেলে পুরো রমজান জুড়ে রোজাদারদের বিনামূল্যে সাহরি ও ইফতারি খাওয়ান। রমজানের প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ মানুষ সেখানে বিনামূল্যে সাহরি ও ইফতারি খান।
সরেজমিনে হোটেলের ভেতরে ঢুকে দেখা গেল রফিকুল ও তার কর্মচারীররা সাহরির খাবার পরিবেশন করছেন। সাহরির খাবার তালিকায় ছিল গরুর মাংস, মাছ ও শাক।
কর্মচারীরা জানান, ইফতারিতে ছোলা বুট, বুন্দিয়া , মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি ও শরবত থাকে। এসব খেয়ে রোজাদাররা তৃপ্ত হন। তারা আমাদের জন্য দোয়া করেন।
স্থানীয়রা জানান, হোটেল মালিক রফিক ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা করেন। আক্কেলপুর পৌর শহরেই তার বাসা। সাত বছর ধরে তিনি রমজান মাসে বিনামূল্যে এ কাজ করে যাচ্ছেন। কলেজ হাটে আসা লোকজন, ব্যবসায়ীরা, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা এই হোটেলে সাহরি ও ইফতারি খান।
আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর সঙ্গে আসা মাতাপুর গ্রামের আসলাম হোসেন বলেন, সাহরির সময় দেখি রফিক হোটেল খোলা আছে। অনেক মানুষ সাহরি খাচ্ছেন। আমিও টেবিলে বসলাম। খেয়ে ক্যাশে গিয়ে টাকা দিতে চাইলাম কিন্তু হোটেল মালিক টাকা নেননি। পরে জানলাম রফিক হোটেলে সাত বছর আগে থেকে রোজাদারদের ফ্রিতে সাহরি ও ইফতারি খাওয়াচ্ছেন।
হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা খালেদা বলেন, এখানে টাকা ছাড়াই সাহরির খাবার দেওয়া হয়। এ খবর পেয়ে আমি এসে সাহরি খেয়েছি। তারা কোন টাকা নেয়নি।
আক্কেলপুর বাজারে এসে কাজ শেষে সাহরি খেতে গিয়েছিলেন মাছ ব্যবসায়ী রশিদ। তিনি বলেন, সাহরির খাবার খেয়ে বিল দিতে গেলে হোটেল মালিক বিল নিলেন না। বললেন, রমজান মাসে এখানে সাহরি ও ইফতার খাওয়া ফ্রি। এটা দেখে খুবই ভালো লাগল। আমি মুগ্ধ হলাম। রমজান মাসে তিনি খুবই ভালো ও সওয়াবের একটি কাজ করছেন। এমন কাজ যদি সবাই করত!
গোপীনাথপুরের শাহিন হোসেন বলেন, আমি বাজারে এসেছিলাম। ইফতারির সময় হওয়ায় রফিক হোটেলে গিয়ে ইফতার করেছি। আমার কাছে ইফতারির টাকা নেয়নি। আমার মতো অনেকেই ইফতারি করেছেন। হোটেলের মালিক কারও কাছে টাকা নেয়নি।
আক্কেলপুর পৌরসভার ৪ নম্বর ওর্য়াড কাউন্সিলর আমিনুর ইসলাম বলেন, রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম তার হোটেলে সাত বছর ধরে ফ্রিতে সাহরি ও ইফতারি খাওয়াচ্ছেন। এটি একটি মহৎ কাজ। রফিক ছোট ব্যবসায়ী হলেও তার মন অনেক বড়।
স্থানীয় সাংবাদিক চম্পক কুমার ও রবিউল ইসলাম রুবেল জানান, সমাজে অনেক বিত্তবান আছে কিন্তু মহৎ উদ্যোগ নেবার মতো মানুষের অনেক অভাব। রফিকের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এ বিষয়ে হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি আক্কেলপুর বাজারের ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ী। এই রমজান মাসে খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ থাকে। এসময় কলেজ হাটে আসা গরীব লোকজন, ব্যবসায়ী, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজন ও রেল স্টেশনে আগত যাত্রীরা সাহরি ও ইফতারি নিয়ে নানা বিপত্তিতে পরেন। তাদের কষ্টের কথা ভেবে সারাবছর আমার ব্যবসার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে, দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিনামূল্যে রোজাদারদের জন্য হোটেলেই ইফতারি ও সাহরি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমি যত দিন বাঁচব যেন এটা চালু রাখতে পারি।