চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ষোড়শ সংশোধনী: ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়টা আগে পড়তে হবে, বুঝতে হবে

৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাংলাদেশের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে৷ ১ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায় প্রকাশ করা হয়। এই রায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টির বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন প্রবাসী ব্যারিস্টার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদার।

ফেসবুকে নিঝুম মজুমদার লিখেছেন,

“সংবিধানের ১৬ তম সংশোধনী বাতিল করে পুরো রায়টা ৭৯৯ পৃষ্ঠার। এই রায়টা যেমন দীর্ঘ ঠিক একই ভাবে বিষয়টা অত্যন্ত জটিল। এটি বুঝতে হলে আমাদের সংবিধান, সংবিধানের উৎস, ইতিহাস, একটি সংবিধানের বেসিক ফ্রেম/স্ট্রাকচার এইসব সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না রাখলে এই রায়টা নিয়ে কথা বলাটা অন্যায় শুধু নয়, আমি বলব ঘোরতর অন্যায়।

শুধু যে উপরে বলা বিষয়গুলো বুঝতে হবে কেবল তা-ই নয়। এই রায়ের সাথে আসা রেফার্ড মামলা গুলো কিংবা এই বিষয় সম্পর্কিত ল্যান্ডমার্ক কিছু মামলা সম্পর্কে খুব ভালো একটা জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন মিনার্ভা মিলস, কেশাভানন্দ মামলা, গোলকনাথ মামলা ইত্যাদি।

আমি এই পর্যন্ত এই রায় নিয়ে যাদের কথা বলতে দেখেছি, গালাগাল করতে দেখেছি তাঁদের বেশীর ভাগই আইনের ছাত্র/ছাত্রী নন কিংবা আইন অঞ্চলের সাথে তাঁদের যোগাযোগ নেই। আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে এই ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায় পুরোটা পড়েই কি তাঁরা এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, নাকি জাস্ট বলতে হবে বলেই বলা?

আমি গত কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা করছি রায়টা মন দিয়ে পড়তে। যে পর্যন্ত পড়েছি, তাতে করে প্রধান বিচারপতি এক লম্বা ইতিহাসের আলোচনা চালিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁর শুরুর বক্তব্যের সাথে মূল আলোচনার আসলেই কি সম্পর্ক, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। পড়ে দেখছি, হয়তবা সম্পর্ক রয়েছে। রায় পড়া শেষ হলে হয়ত একটা প্রচ্ছন্ন ধারনা পাওয়া যাবে।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার পালটে কিছু করা যাবে না এমনটা বলে ৮ম সংশোধনীর রায় আমরা দেখেছি যদিও আমাদের সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার আসলে কি সেটি স্পষ্ট করে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো বলেন নি। একটা ধারনা হয়ত দেবার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু স্পস্ট করে কিছুই বলা হয়নি। আমাদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর সময়েও এই বেসিক স্ট্রাকচার ইস্যুতে অনেক আলোচনা হয়েছিলো।

৮ম সংশোধনীতে বিচারপতিরা যে ব্যাপার নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন এবং যে কারনে সূপ্রীম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরন তাঁরা সে সময় ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন এরশাদের আমলে সেটিতে বিচারপতিদের স্বার্থ স্পষ্টভাবেই জড়িত ছিলো। একইভাবে ১৬ তম সংশোধনীতেও বিচারপতিদের স্বার্থ স্পষ্টভাবে জড়িত রয়েছে। সুতরাং রায়টা পড়বার সময় এইসব বিষয় মাথাতে আসলে “বিচারপতিরা নির্মোহ ভাবে বিবেচনা করছেন” এই বক্তব্যতে খানিকটা ছেদ পড়ে।

আমাদের দেশে কিছু বিচারপতি সামরিক শাসকদের সাথে অতীতে হাত মিলিয়েছিলেন, দূর্নীতির সাথে জড়িত হয়েছিলেন, খুনীদের পদলেহন করেছেন, এসব কিন্তু শুধু ঐতিহাসিক সত্যই নয় বরং সেগুলো আজও নানাভাবে আমাদের হন্ট করে বেড়ায়।

একটা বিষয় মনে রাখা জরুরী যে সূপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি শুরু হয়েছিলো অবৈধ সামরিক শাসক জিয়ার আমলে। আমাদের মূল সংবিধানে সব সময়ই সংসদ সদস্যদের হাতে বিচারপতিদের ইম্পীচমেন্ট ক্ষমতা ছিলো। জিয়ার করা একটা অবৈধ পদ্ধতিকে কেন বিচারপতিরা এই সময়ে এসে এত গুরুত্ব দিয়েছেন? এটা জানা জরুরী।

যদিও এটিও বলে নেয়া ভালো যে, সময় গড়াবার ফলে সেই আদি সংসদের মেধা আর আজকের সংসদের মেধা এক না। আমাদের এখনকার সময়ে বেশীরভাগ সাংসদের সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুতরাং এদের হাতে বিচারবিভাগের একজন বিচারপতির ভাগ্য ছেড়ে দেয়াটাও ঝক্কির ও আশংকার।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারটা নানাভাবেই জরুরী কিন্তু সেটি কি একটি বিভাগকে সব কিছুর উর্ধে নিয়ে গিয়ে একটা চেক/ব্যালেন্সের জায়গা একেবারে মুছে দিচ্ছে কিনা এটা জানাও জরুরী। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন তিনটি বিভাগ আমাদের মত দেশে একেবারে সার্বভৌম হলে এখানে আধিপত্যের ব্যাপার চলে আসবেই। সুতরাং সব বিভাগেই সুতোর একটা টান থাকা জরুরী মনে হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে একজন সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দূর্নীতির ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছিলো। ঠিক তখনই আপীলেট ডিভিশান থেকে দূর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়ে বলা হোলো যে এই বিচারপতির বিরুদ্ধে যাতে তদন্ত না করা হয়। কারন হিসেবে বলা হয়েছিলো যে একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে দূর্নীতির তদন্ত হলে পাব্লিক কনফিডেন্সে প্রভাব পড়বে।

কী ভয়ানক কথা!!! একজন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ থাকার পর সেটি করতে না দেয়াটা কিংবা যারা বিচার করবেন তাঁদের পক্ষ থেকে বাঁধা দেয়াটা একটা ভয়ানক অপরাধ। এই পুরো ঘটনা আমাকে অত্যন্ত আতংকিত করেছে এবং বিচারপতিদের স্বাধীনতা বিষয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে।

আমাদের দেশে যিনি লংকায় যান, তিনিই রাবণ হয়ে ওঠেন। আর সে কারনেই ১৬ তম সংশোধনীর একেবারে পক্ষে বলাটা কিংবা একেবারে বিপক্ষে বলাটা দুটোই অত্যন্ত কঠিন।

তবে একটা নির্মোহ স্থান থেকে দেখবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়টা পড়তে হবে। পড়ে বুঝতে হবে।”