ভারতীয় ভাষার সন্ধানে নেমেছিলেন গণেশ দেবী (৬০)। ভেবেছিলেন, মৃত বা মরণাপণ্ন মাতৃভাষায় পূর্ণ কবরের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে তাকে। কিন্তু তিনি দেখলেন, হাঁটছেন ‘শব্দের ঘন জঙ্গল’ দিয়ে, একটি কোলাহলপূর্ণ দূর্গ দিয়ে।
বিশ্বের অন্যতম জনবসতিপূর্ণ দেশের ৭৮০টি ভাষা ‘আবিষ্কার’ করেছেন ড. গনেশ দেবী ও তার সংস্থা পিউপিল’স লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া (পিএলএসআই)। গুজরাটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ইংরেজী ভাষার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপরেই নামেন ভাষার সন্ধানে।
ভাষাবিদ হিসেবে কোন প্রশিক্ষণ নেই ড. দেবীর। তবে মৃদুভাষী এই ব্যক্তির রয়েছে লক্ষ্যের প্রতি অবিচল মনোভাব। অধ্যাপনা শেষে স্থানীয় উপজাতিদের নিয়ে কাজ করতে প্রান্তিক গ্রামে যান তিনি। ঋণ, বীজ ব্যাংক পরিচালনা এবং স্বাস্থ্যগত প্রকল্পে প্রবেশাধিকারের জন্য স্থানীয়দের সাহায্য করেন তিনি। এসময় ১১টি আদিবাসী ভাষা নিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন।
এসময়ে ভাষার শক্তি প্রথম উপলব্ধি করেন ড. দেবী। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় ভাষার ৭০০ কপি জার্নাল একটি অতিদরিদ্র আদিবাসী গ্রামে নিয়ে যান তিনি। ১০ রুপি রেখে এগুলো কেনার জন্য একটি ঝুড়ি রাখেন সেখানে। দিন শেষে দেখেন সব কপি শেষ, আর ঝুড়িটি ময়লা-দীর্ণ নোটে পূর্ণ।
দেবী বলেন “ঝুড়িতে দেখি গ্রামবাসীরা তাদের সামান্য আয় থেকে ময়লা অনেক নোট সেখানে রেখে গেছেন। তারা তাদের নিজস্ব ভাষাকে প্রথম প্রকাশ পেতে দেখেছে। দিন এনে দিন খাওয়া এই অশিক্ষিত লোকেরা যে জার্নালের জন্য টাকাগুলো দিয়েছে, তা তারা পড়তেও পারে না।”
“তখন আমি বুঝতে পারলাম ভাষার জন্য আদিম সেই গর্ব এবং ভাষার শক্তির বিষয়টি।”
সাত বছর আগে ভারতীয় ভাষার উপর সার্ভে চালাতে ড. দেবী পিউপিল’স লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া (পিএলএসআই) প্রতিষ্ঠা করেন।
ভাষার সন্ধানে ১৮ মাস ধরে ৩০০ বার ভ্রমণ করেছেন তিনি। কোন কোন রাজ্যে ১০ বারেরও বেশি ভ্রমণ করেছেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে লিপিবদ্ধ করেছেন ডায়েরিতে। এই ভ্রমণের অর্থ তিনি পেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে বক্তব্য দিয়ে।
এসময় তিনি দেখেছেন, হিমালয় রাজ্যে যে ১৬টি ভাষায় কথা বলা হয়, তাতে শুধু তুষারের জন্যই রয়েছে ২০০টি শব্দ। যাতে ‘পানিতে তুষারপাত’ বা ‘চাঁদ রাতে তুষারপাতের’ মতো বর্ণনামূলক শব্দ রয়েছে।
দেখেছেন, শুষ্ক ভূ্-প্রকৃতি বর্ণনায় রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলের যাযাবর জাতি বিশাল শব্দভান্ডার ব্যবহার করে। মহারাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে বেশ কয়েকটি গ্রামের অধিবাসীরা কথা বলে ‘অপ্রচলিত সেকেলে’ পর্তুগিজ ভাষায়। আন্দামান নিকোবর দ্বিপপুঞ্জের অধিবাসীরা মিয়ানমারের ‘কারেন’ ভাষায় কথা বলে। গুজরাটে বাস করা কয়েকজন অধিবাসী জাপানিজ ভাষাতেও কথা বলে। তিনি দেখেছেন, ভারতীয়রা ১২৫টি বিদেশি ভাষাকে তাদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।
সাড়ে তিন হাজার বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, অধিকারকর্মী, বাস ড্রাইভার এবং যাযাবরদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন ড. দেবী। এদের একজন আমলার ড্রাইভার। যিনি পেশাগত কাজে উড়িশায় গিয়ে নতুন শব্দগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখেন। ভাষার ইতিহাস ও ভূগোল বিষয়ে স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার নেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
এই কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ২০১১ সালের মধ্যে পিএলএসআই ৭৮০টি ভাষা রেকর্ড করে। সংস্থাটির ১০০টি বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে ৩৯টি বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে ভাষাবিষয়ক তাদের খুঁজে পাওয়া লুপ্তভাষাও রয়েছে। এছাড়াও ৩৫ হাজার পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি প্রকাশের জন্য যাচাই করছে সংস্থাটি।
১৯৬১ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতীয় ভাষার সংখ্যা ১ হাজার ৬৫২টি। পিএলএসআই-এর ২০১০ সালের হিসেবে ৭৮০টি ভাষার কথা জানা যায়। ইউনেস্কোর মতে, এরমধ্যে ১৯৭টি বিপদাপন্ন, ৪২ টি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। উত্তর-পূর্বে অরুনাচল প্রদেশ এবং আসাম, পশ্চিমে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট, পূর্বে উড়িশা ও বাংলায় এবং উত্তরে রাজস্থানে সবচেয়ে বেশি ভাষা রয়েছে। দেশটিতে ৩৫টি ভাষার পত্রিকা প্রকাশিত হয়। হিন্দি (৪০ শতাংশ) ভারতের সবচেয়ে ব্যবহৃত ভাষা। এরপরে রয়েছে বাংলা (৮ শতাংশ), তেলেগু (৭.১ শতাংশ), মারাঠি (৬.৯ শতাংশ) এবং তামিল (৫.৯ শতাংশ)। রাষ্ট্রীয় অল ইন্ডিয়া রেডিও (এআইআর) ১২০ ভাষার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। ভারতের সংসদে মাত্র ৪ শতাংশ ভাষার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। (সূত্র: ভারতের পরিসংখ্যান, ২০০১, ১৯৬২, ইউনেস্কো, পিউপিল’স লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া ২০১০)
সরকারি সমর্থনের অভাবে কয়েকশ ভাষা হারিয়েছে ভারত, বিভিন্ন ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে। এর জন্য দায়ী স্থানীয় ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অপ্রতুলতা ও আদিবাসীদের অভিবাসন। ভাষার মৃত্যুকে সবসময় একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়, এতে হারিয়ে যায় স্থানীয় জ্ঞান, উপকথা, গল্প, সঙ্গীত।
ড. দেবী বলেন, অন্যান্য উদ্বিগ্নতাও চেপে বসছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি হিন্দি ভাষাকে পুরো ভারতে আরোপ করতে চায়, যাকে তিনি বলেছেন, ‘ভাষাগত বৈচিত্র্যের উপর সরাসরি আক্রমণ’। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মুখে ভারতে মেগাসিটিগুলো কিভাবে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখবে তাও চিন্তার বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কর্ণাটক রাজ্যের ধারওয়াদ শহরে নিজের বাসায় বসে ড. দেবী বিবিসিকে বলেন, একটি ভাষার মৃত্যু হলে আমি দুঃখ অনুভব করি। আমাদের অন্যান্য বৈচিত্র্যও হুমকির মুখে।
“আমাদের ভাষাগুলো অনেকটা একগুঁয়েভাবে বেঁচে আছে। আমরা আসলেই একটি ভাষাগত বৈচিত্র্যের গণতন্ত্র। আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, আমাদের ভাষাকেও জীবিত রাখতে হবে।”