আইনটি নিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। কিন্তু সব রকম সমালোচনা, আপত্তি, উদ্বেগ ও অংশীজনের মতামত উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাস করা হলো। এর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করা হলো বটে, কিন্তু অনুরূপ ৩২ ধারাসহ বেশকিছু বিতর্কিত ধারা রেখে আইনটিকে আরও বেশি আগ্রাসী বানিয়ে পাস করা হলো। কাজটি করা হলো জনমতের তোয়াক্কা না করে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজের সুবিধা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। কারণ এ বিধানগুলোর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রবল।
উল্লেখ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে শাস্তি বাড়িয়ে আইনটিকে আরও কঠোর করা হয়।
এ আইনের ৫৭ ধারায় গত কয়েক বছরে সাংবাদিক ও সরকারি দলের প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ বহু মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরণগুলো উল্লেখ ছিল একসঙ্গে, নতুন আইনে সেগুলো বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে দেয়া হয়েছে মাত্র। আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এখানে অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা কিছুটা কমানো হয়েছে। আবার ১৪টি ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারায় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়রানির আশঙ্কা প্রবল, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেমন, আইনটির ৩২ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন, তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর এ অপরাধ একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বার বার করলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সরকার আসলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা হিসেবে আরও শক্তপোক্তভাবে ফিরিয়ে এনেছে। আমাদের দেশে এমনিতে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাসীনরা নিজের স্বার্থে আইনের অপপ্রয়োগ করেন। নতুন আইনেও সেই সব বিধান রেখে দেয়া হয়েছে। আইনটি সংবিধানের মূল চেতনার বিশেষ করে মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিকাশের পথ রুদ্ধ করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতাবোধ সৃষ্টি করবে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন ও সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। আমাদের সংবিধানের ৩৯ ধারায় গণমাধ্যম ও মুক্তচিন্তার অধিকার দেয়া হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সরকার এমন কোনো আইন পরিচালনা করবে না, যা স্বাধীন চিন্তায় কোনো ধরনের চাপ অনুভব করবে। কিন্তু এই আইনটি সংবিধান থেকে অনেক দূর চলে গেছে। ৫৭ ধারা করার পর আমরা এর অপব্যহার দেখেছি। ৫৭ ধারার চেয়ে এই আইনের ধারাগুলো আরও বেশি কড়া। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কেউ যদি অনলাইনে খবর প্রকাশ করে সেখানে কাঁচি চালানোর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সরকারবিরোধী কোনো ধরনের খবর প্রকাশ করলে আলোচনা ছাড়াই সেই অনলাইন ব্লক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
গণমাধ্যমসহ সব নাগরিক যাতে কোনো ধরনের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে তার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করাই সরকারের কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু নতুন এই আইন পাসের মধ্য দিয়ে যেন সরকার গণমাধ্যমসহ সমালোচকদের একটি নতুন বার্তা দিল। বার্তাটি হচ্ছে: সাবধান, এদেশে থাকতে হলে হুঁশ করে কথা বলতে হবে, রেখেঢেকে মত প্রকাশ করতে হবে। ইশারা-ইঙ্গিতেও সরকারের সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা করলে কোনো একটি ধারায় ফেলে এমন ‘টাইট’ দেয়া হবে যে, বাকি জীবন ঈশ্বরের আরাধনা করেই কাটিয়ে দিতে হবে!
এই আইনের বিরুদ্ধে যে সব সমালোচনা হয়েছিল, বিভিন্ন বৈঠকে যেসব নেতিবাচক দিক চিহ্নিত করা হয়েছিল, সরকার সেসবের কিছুই আমলে নেয়নি। যৎকিঞ্চিৎ যে সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে এই আইনের উদ্দেশ্য বা মর্মবস্তুর কোনো বদল ঘটেনি। নতুন আইনের ৩২ ধারা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটি ধারা। এই ধারার একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতিরেকে সরকারি তথ্য সংগ্রহ করলে তাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। ফলে এই আইনের ভেতরে এমন ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়েছে, যা কেবল শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিরুদ্ধেই নয়, কার্যত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পথকেই প্রশস্ত করেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটির রচয়িতার নাম যদি হতো ডোনাল্ড ট্রাম্প অথবা কিম জং-আন, তবে বিস্ময়ের কারণ থাকত না। কিন্তু আইনটির জন্মস্থান বাংলাদেশ। বিস্ময়টা সেখানেই। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কী ভাবে এমন একটি দমনমূলক আইন জন্মাতে পারে? এই আইনটি স্বচ্ছ তো নয়ই, বরং এর ব্যাপ্তি বিপুল ও পরিণাম ভয়ঙ্কর। যাঁরা সংসদে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় চৌকিদারের ভূমিকা পালন করছেন, তাঁরা আইন পাশ করবার সময় একমুহূর্তও কি এই আইনের পরিণাম ভেবে দেখেছেন? নাকি সমালোচনার ভয়ে তারা এতটাই ভীত হয়ে পড়েছেন, যে এখন নিজেরাই রক্ষাকবচ হাতে ৩২ ধারার গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন?
এই আইনটির পক্ষে ক্ষমতাসীনরা যতই সাফাই গাক, এর ৩২ ধারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি অনপনেয় কালো দাগ হিসেবেই থেকে যাবে। ইনডেমনিটি, বিশেষ ক্ষমতা এবং ৫৭ ধারার মতোই। এক অর্থে এই দাগটি গভীরতর। কারণ এই আইনটি সরকার একতরফাভাবে সংসদে পাস করছে। বিরোধী দল কিংবা গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টদের কোনো আপত্তি ও অভিমত এই আইন পাসের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হিসেবে ধরা হয়নি। এই আইন পাসের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ‘শাসক’ চরিত্রটিই চিনিয়েছেন। তাঁদের মানসিকতাটি শাসকের। শাসকের রঙ হয় না। যে কোনও বিরুদ্ধ স্বর তাঁদের কানে বিপজ্জনক ঠেকে। অতএব, শাসকরা এক জোট হয়ে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করবার ব্যবস্থা করেছেন। এই পাপ মুছবার নয়। ৩২ ধারার বাইরেও কিন্তু যে কোনও ‘বেয়াড়া’ নাগরিককে শায়েস্তা করবার অস্ত্র রাষ্ট্রের তূণে বিলক্ষণ মজুত রয়েছে। তারপরও এই ধারাটি রেখে দেয়া হলো। এই ধারাটির প্রধান মহিমা হচ্ছে, এর মাধ্যমে কার্যত যে কোনো নাগরিককে হয়রান করবার অধিকার রাষ্ট্রের আয়ত্তে রইল। অতঃপর কেউ যদি নিজের অসন্তোষও প্রকাশ করেন, তাহলেও তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া যাবে। ‘উচিত শিক্ষা’ পেতে এখন আর কোনো নাগরিকের বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী হওয়ারও প্রয়োজন নেই। একটু ফোঁস করলেই সোজা হাজতে।
এমনিতেই আমাদের দেশে নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারটুকু অত্যন্ত সীমিত। এখন যেন তার গলায়ও একটা ফাঁস পরিয়ে দেয়া হলো। একদিক থেকে ভালোই হলো। নাগরিকের অধিকার, নাকি রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর পিঠ, কোনটি রক্ষা করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অস্তিত্বের মূল কারণ? এই প্রশ্নটির মীমাংসা হয়ে গেল। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপরিচালনাকারীদের পিঠই যে আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য-আমাদের মতো আহাম্মকেরা বিষয়টি নতুন করে আবারও উপলব্ধি করলাম!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)