সাঁইত্রিশ বছর পেরিয়ে সম্ভাবনার মধ্যে দাঁড়িয়েও চরম সংকটাপন্ন অবস্থা পার করছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
তিনযুগেরও বেশি সময় পার করা দলটির এরকম অবস্থার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নেতৃত্বের দুর্বলতা, দ্বিতীয় সারিতে বিকল্প নেতৃত্ব না থাকা, সুবিধাবাদিতা, সরকারের ‘দমনমূলক’ পদক্ষেপের বিপরীতে সাহসী সংগঠকের অভাব, রাজনৈতিক চালে ভুল এবং জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিহীনতাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ক্ষমতায় থেকে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি নামে যে দলটি গঠন করেন, তার মৃত্যুর পর সেই দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। দুই দুইবার ক্ষমতায়ও আনেন তিনি দলকে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, তিনযুগ পরে আজ অনেকটাই ‘ছন্নছাড়া’ অবস্থায় আওয়ামী রাজনীতিবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে দলটির বর্তমান অবস্থা এবং সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাদের কেউ বলেছেন, বিএনপি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক, কিন্তু প্রবল জনসমর্থন আছে তাদের। কিন্তু কেউ আবার বলছেন, বিএনপি এখন সোনালী অতীত ক্লাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারী বললেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মূলত: দুই ধরনের রাজনীতির সমর্থক আছে। একদল আওয়ামী লীগ ক্যাম্পের এবং অন্যদল আওয়ামী লীগ বিরোধী ক্যাম্পের। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে না এমন একটি পুরো দলই বিএনপিকে সমর্থন করে। সাধারণ মানুষও এখন বলাবলি করে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। কিন্তু সেই সুযোগটা তাকে দিতে হবে। সুতরাং বলা চলে আজও বিএনপি আগের সেই অবস্থান রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদ অবশ্য বললেন, এখন বিএনপির অবস্থা যে খুবই নাজুক সেটা সবাই জানে। কিন্তু তাদের এই অবস্থা কিন্তু সবসময় এরকমই ছিলো না। অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখবো খালেদা জিয়া তার সময়ে যে জনসম্পৃক্ততা অর্জন করতে পেরেছিলেন সেটা জিয়াউর রহমানও তার শাসনামলে পারেননি। তারা ক্ষমতায় এসেছে এবং জনপ্রিয় দল হিসেবেই এসেছে। এমনকি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও বেশ দৃঢ় অবস্থান দেখিয়েছে বিএনপি। সেসবই তাদের সোনালী অতীতের কথা বলে, কিন্তু বর্তমানে তাদের অবস্থা কারোরই অজানা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, বিএনপি যেমন একইসঙ্গে খুবই শক্তিশালী অবস্থানে আছে, তেমনই খুব দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এখনো যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় তাহলে বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। কিন্তু সেটা পেতে হলে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হবে, নিজেদের কর্মীদের যেভাবে সমবেত করতে হবে সেই শক্তিটা এখন আর বিএনপির মধ্যে নেই।
বিএনপির এমন পরিস্থিতির পেছনে দলের নানা কিছুর অভাবকেই দায়ী করলেন তিন রাজনীতি বিশ্লেষক।
নূরুল আমিন বেপারী মনে করেন, বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনসম্পৃক্ততা কম। জনগণের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন হবে তেমন কোনো কর্মসূচি তাদের হাতে নেই। বিদেশের হস্তক্ষেপের আশায় বসে থাকাটাও নিশ্চয়ই সুফল বয়ে আনবে না বিএনপির জন্য। তাছাড়া তাদের এমন অবস্থানের আর একটি বড় কারণ হলো, দলের কিছু সুবিধাবাদী কর্মী। তাদের জন্য দলের অবস্থান এবং ভাবমূর্তি দুটোই নষ্ট হচ্ছে। আবার ঠিকভাবে সংগঠিতও হতে পারছে না এই দলটি।
বশির আহমেদের অবশ্য বিএনপির এই অবস্থানের জন্য তাদের বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবকেই দুষলেন। বললেন, সেসবের পাশাপাশি নেতৃত্বের সমস্যাতো আছেই। কোনো ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপ তৈরি করতে পারেনি বিএনপি। আর একটি সমস্যা রয়েছে তাদের, সেটার নাম মিসকমিউনিকেশন। তারেক রহমান থাকছেন বিদেশে, সেখান থেকেই বা দলকে তিনি কিভাবে কতোটা সামনের দিকে পরিচালনা করতে পারবেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, একই সঙ্গে দুর্বল ও শক্তিশালী হবার কারণেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বিএনপিকে। শক্তিশালী মানে জনগণের সমর্থন রয়েছে, কিন্তু সেটাকে প্রতিষ্ঠা করতে যা করা দরকার তা করার মতো শক্তি বিএনপির নেই।
এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিএনপিকে আরো বেশি ইতিবাচভাবে কাজ করারই আহবান বিশ্লেষকদের।
নুরুল আমিন বেপারী বলেন, বিএনপি আরো জনগণসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিতে পারে। যে সব বিষয়ে জনগণের চাওয়া রয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করলে আরো জনগনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। জ্বালাও-পোড়াও না করে এসবই নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে বিএনপিকে। সেজন্য বাস্তববাদী চিন্তাকে আরো বেশি কাজে লাগাতে হবে তাদের।
আর বশির আহমেদ মনে করেন, তারেক রহমান যদি বিএনপির তুরুপের তাস হন তাহলে তাকে দেশে আসতেই হবে। তা না হলে দলের কোনো অবস্থান কোনোভাবেই পরিবর্তন হবে না। পরিকল্পনা করতে হবে, সঙ্গে বুদ্ধিমত্তাও কাজে লাগাতে হবে। সরকারের সঙ্গে সব সময় দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে ইতিবাচক কর্মসূচি নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা সকলেই বলছেন, বিএনপি নিজের ভুলেই নিজেদের অবস্থান হারিয়েছে। দলের নেতৃত্ব হারিয়েছেন তার প্রটোকল, সুতরাং সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বাড়তি উদ্যোগ নিতেই হবে এই দলটিকে।