চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

৩৩ ঘন্টার ‘জিম্মিদশা’ ‍শেষে চেনা রূপে রাজধানী ও দূরপাল্লার পরিবহন ব্যবস্থা

প্রায় ৩৩ ঘন্টা অসহনীয় জনদূর্ভোগ এবং শ্রমিক-পুলিশ দফায় দফায় সংঘর্ষ শেষে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে রাজধানীসহ সারা দেশের যান চলাচল। ছেড়ে যাচ্ছে দুরপাল্লার বাস।গণপরিবহনের দেখা মিলছে রাজধানী জুড়ে। নগর ফিরে পাচ্ছে তার চেনা রূপ।অনাকাঙ্খিত জিম্মি দশা থেকে মুক্ত জনমানুষের মধ্যে ফিরতে শুরু করেছে স্বস্তি।

আদালতের রায়ে দণ্ডিত বাস চালকের দণ্ড বাতিল করে নতুন করে বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে পরিবহন শ্রমিকেরা ওই ধর্মঘটে গিয়েছিল। বুধবার বিকেল তিনটার কিছুটা আগে উঠে যাওয়া ওই ধর্মঘটে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। যাতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় যাত্রী সাধারণকে।

বুধবার দুপুরের পর নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সংবাদসম্মেলন করে চালকদের গাড়ি চালানোর আহ্বান জানানোর পর থেকে শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। বাসগুলো প্রস্তত হয় চলাচলের জন্য। দুরপাল্লার বাসগুলোর কাউন্টার খুলে শুরু হয় যাত্রী ডাকাডাকি এবং টিকেট বিক্রি। সন্ধ্যা নাগাদ গাবতলীর বাস টার্মিনালে দেখা যায় দুরপাল্লার যাত্রীদের ভিড়।

প্রায় দুইদিন রাজধানীর রাস্তায় কেবল বিআরটিসির লাল বাস ছাড়া অন্য কোন বাস চোখে না পড়লেও, তিনটার পর থেকে গণপরিবহনের দেখা মিলতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ যানবহনের চাপ আরও বেড়ে ফার্মগেটসহ বিভিন্ন বাস স্টপেজগুলোতে বাসের অতিরিক্ত চাপও দেখা যায়।

৩৩ ঘণ্টার অসহনীয় দুর্ভোগ

কোন পুর্বঘোষণা ছাড়াই মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘটে গিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকেরা। ওইসময়ের মধ্যে রাজধানী ছাড়তে পারেনি কোন দুরপাল্লার বাস। নগরে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলোও বন্ধ থাকে শ্রমিকদের পিকেটিং ও সহিংস আচরণের কারণে। ঝুঁকি নিয়ে দুই-একটি বাস চলাচল করলেও শ্রমিকদের বাঁধার সম্মুখীণ হতে হয়, ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে কোথাও কোথাও। মঙ্গলবার সকাল থেকেই চরম দুর্ভোগে পরতে হয় নগরবাসীসহ দুরপাল্লার যাত্রীদের।

গণপরিবহন না পেয়ে সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা-ভ্যানে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওনা হতে দেখা যায় অফিসগামী নগরবাসীদের। অনেকে কোন যানবাহনের ব্যবস্থা না করতে পেরে হেঁটেই রওনা হন।

রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে দেখা যায় দুরপাল্লার যাত্রীদের ভোগান্তি। অনেকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও যেতে পারেননি নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গাবতলী বাস টার্মিনালে কয়েকটি পরিবার সোমবার রাত থেকে অপেক্ষা করেছে বলে জানা গেছে।

এরপরেও অতি জরুরী প্রয়োজনে যাদের রাজধানীতে আসতে হয়েছে বা রাজধানী ছেড়ে অন্য গন্তব্যে যেতে হয়েছে তাদের ভোগান্তি ছিল সীমাহীন।

মাদারিপুরের টেকেরহাট থেকে বিকেল তিনটার কিছু আগে ঢাকায় আসেন মেহেদী হাসান নামে এক যুবক। যাত্রাপথের ভোগান্তির বর্ণনা দিয়ে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, টেকেরহাট থেকে একটি লোকাল বাসে কাওড়াকান্দি ঘাট পর্যন্ত আসতে অন্তত পাঁচবার শ্রমিকদের বাঁধার সম্মুখীণ হয়েছি। ঘাট পার হয়ে মাওয়া এসে দেখি কোন গাড়ি চলছে না। তাই প্রথমে রিকশা, তার পরে ভ্যান এবং পিকআপে আসার পর ধলেশ্বরী সেতুর কাছাকাছি এসে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাই।

‘সাধারণত টেকেরহাট থেকে ঢাকায় আসতে ২০০-২৫০ টাকা লাগে কিন্তু আমার আজ খরচ হয়েছে সাড়ে আট শ’ টাকার মত।’

এভাবে আসতে ভোগান্তির পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত অনেক অর্থ খরচ করতে হয়েছে রাজধানীমুখী অনেককে।

 

রণক্ষেত্র গাবতলী

মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিকে গাবতলীতে একটি রেকার ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই ধর্মঘট রূপ নেয় সহিংসতায়। শ্রমিকেরা টায়ারে আগুন ধরিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। বুধবার সকাল ১১টার দিকে শ্রমিক-পুলিশ দফায় দফায় সংঘর্ঘের এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন এক বাসচালক। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, ‍পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে শ্রমিকেরা। পাল্টা আক্রমনে পুলিশও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। দফায় দফায় পুলিশের ছোড়া কাঁদনে গ্যাসে পুরো গাবতলী এলাকায় সৃষ্টি হয় অসহনীয়  পরিবেশের।

‘সহিংস’ শ্রমিকদের আক্রমন থেকে রেহাই পাননি সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্সের রোগী এমনকি গণমাধ্যমকর্মীরাও।

মঙ্গলবার দিনগত রাত দুইটার দিকে মাজার রোড এলাকায় শ্রমিকদের হামলার কবলে পড়ে রোগীবাহিত একটি অ্যাম্বুলেন্স। এতে রোগীসহ তার স্বজনেরা আহত হন। বুধবার বিকেলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান চালকদের গাড়ি চালাতে অনুরোধ করার পর গাবতলী টার্মিনালের পরিস্থিতি দেখতে গাবতলী যাওয়ার পথে শ্রমিকদের হামলার কবলে পড়েন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী।

যেভাবে সমাধান:

ধর্মঘটের ফলে জনদুর্ভোগ লাঘবে বিভিন্ন শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে বৈঠক করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বুধবার বেলা ১১টার দিকে তার দপ্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন।

নৌমন্ত্রী শাজাহান খান দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। আর প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা বাস ও ট্রাকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি।

ওবায়দুল কাদের সঙ্গে বৈঠকের পর মতিঝিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কার্যালয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক করেন শাজাহান খান। শাজাহান খান ছাড়াও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়ত উল্লাহ।

বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে নৌমন্ত্রী বলেন, ‘এখন থেকে যানবাহন চলাচলের জন‌্য মালিক ও শ্রমিক ভাইদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করছি, সারাদেশে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হবে।’

এরপর থেকেই শ্রমিকেরা বিভিন্ন সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নিতে থাকলে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।