ভাষা সংগ্রামী জিল্লুর রহমান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশর ১৯তম রাষ্ট্রপতি। ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে জন্ম। বাবা মেহের আলী মিয়া ছিলেন আইনজীবী, তৎকালীন মযমনসিংহের লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের একজন সদস্য। ভৈরব আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ভৈরব কে. বি পাইলট মডেল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৪৬ সালে। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে ইতিহাস ও পরে আইনে স্নাতক হন জিল্লুর রহমান। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৭৯ এর গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালে তিনি গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭৪ সালে আবারো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি আওয়মী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেব দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি চতুর্থবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করলে জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
পাঁচ বার ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে তিনি (কিশোরগঞ্জ-৬, কুলিয়ার চর-ভৈরব থেকে) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেব দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানও ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় মারা যান আইভি রহমান। তাদের ছেলে নাজমুল হাসান পাপন জাতীয় সংসদের সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। তাদের দুই মেয়ে তানিয়া ও ময়না।
২০-০১-২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন তারিকুল ইসলাম মাসুম।
জিল্লুর রহমান: বলেন, কী বিষয়ে কথা বলব?
তা ই মাসুম: ফেব্রুয়ারি মাস আসছে, ভাষা আন্দোলনের মাস, একজন ভাষা সংগ্রামী হিসেবে আপনার সাথে কথা বলব। ভাষা আন্দোলনে আপনাদের স্মৃতি এবং কাজ সম্পর্কে বলবেন। এছাড়া ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ, বাংলাদেশর এতো বছর। বাংলাদেশের রাজনীতি, ওয়ান ইলেভেন পার করে নির্বাচন হল এই সব সার্বিক বিষয়ে জানতে চাই আপনার কাছে।
জিল্লুর রহমান: আমরা পাকিস্তান আন্দোলন যখন করি, ঐ থেকে সবসময় আমাদের দাবি ছিল যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রে অধিকাংশ লোক বাংলায় কথা বলে। সুতরাং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। দাবি করতে পারতাম। আইনত, ন্যায়ত আমরা বলতে পারতাম। বেশিরভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে, সুতরাং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা কর। কিন্তু তা না করে বলেছি অন্যতম। উর্দুও থাক, আমাদেরটাও রাখ। কিন্তু আমাদের এই ন্যায্য দাবি তারা মানলো না। ফলে, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো। আর রাষ্ট্রভাষা কমিটিতে আতাউর রহমান খান, শামসুল হক সাহেব ওনারা ছিলেন। কমরুজ্জামান ওনারা নেতৃত্বে ছিলেন।
তা ই মাসুম: আপনি ভাষা আন্দোলনে কিভাবে জড়িত হলেন? সেই সময় আপনি তখন কোথায় পড়তেন?
জিল্লুর রহমান: আমি তখন ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলাম। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে একটি প্রোগ্রাম থ্রো করেছিলো ২১শে ফেব্রুয়ারি। হরতাল (১৪৪ ধারা) ভেঙে ছিলাম। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আতাউর রহমান খান ওনারা, তারা এটা এগ্রি করল না। ওনারা এগ্রি না করাতে, আমরা ওখান থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে এসে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় একটা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ করলাম। সেই সংগ্রাম পরিষদে আমরা আগের দিন ২০ তারিখ সন্ধ্যার পর, ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে আমরা ১০/১১ জন বসে, ছাত্রনেতা বসে অনেক আলাপ আলোচনার পর স্থির হল যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা হরতাল করব অবশ্যই। ঐ ১১ জনের মধ্যে আমি একজন ছিলাম।
তা ই মাসুম: ১১ জনের মধ্যে আর কারা ছিলেন?
জিল্লুর রহমান: সেখানে জাস্টিস শেলী (সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী) ছিলেন, মুহিত সাহেব মারা গেছেন, গাজীউল হক আছেন, তারপরে মোমেন সাহেব মন্ত্রী ছিলেন (পরে), এই বসে, আমরা ১১ জন ছিলাম। আমরা ডিসিশন নিলাম, না, আমরা হরতাল করবো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবো। কিন্তু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সাথে আমাদের বিভেদ সৃষ্টি হলো। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে যে ২০ তারিখ যে মিটিং হয়েছিলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের, একটা আম গাছ ছিল, আম্র বৃক্ষ, ঐ মিটিং আমি প্রিজাইড করি।
তা ই মাসুম: এটা কাদের? যে মিটিংটা আপনি প্রিজাইড করলেন? ঐটা কখন হলো?
জিল্লুর রহমান: ২০ তারিখ, তারপরে ২১ তারিখ সকাল বেলা, লোক-জন আসেল, ছাত্র-ছাত্রী ঢাকা শহর একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। ঢাকা তখন কনজারবেটিভ শহর ছিল। মেয়েরা গান শিখবে ঘরে বসে তাও পারত না। ঢিল-টিল মেরে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিতো। আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ সাহেব (শিল্পী) তার বাড়ীতের ঢিল পড়ছে বহুবার।
গান শিখায় এই কারণে সেখানে। ২১শে তারিখ লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, হাজার হাজার মানুষ মেয়েরা, মেয়েদের সংখ্যাও কম না! কয়েক হাজার মেয়ে সেই ২১শে তারিখের মিটিংএ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আমরা এনে উপস্থিত করেছিলাম। এবং প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তখন এসে জড়ো হলো। সেখানে আলাপ আলোচনা হলো। কথা-বার্তা হলো।
এবং ডিসাইড হইল ১৪৪ ধারা না ভেঙ্গেও আমাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। তখন জগন্নাথ হল যেটা ছিল লেজিসলেটিভ হল। সেখানে তখন অধিবেশন বসছে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের সেদিন নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন জেলখানা থেকে যে, তোরা এই অ্যাসেম্বলি করে, যে রকম করে হোক, তোরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তোরা একটা স্মারকলিপি পার্লামেন্ট সদস্যদের দিবি। সেটা নিয়ে দেয়া। তো, প্রথম আমরা ডিসাইড করলাম যে, হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর না ভেঙ্গেই ৪ জন ৪ জন করে। আমরা গেলাম ৪ জন ৪ জন করে তাতে তো হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর ভাঙ্গা হলো না। অধিক হলে ৫ জন হলে ভঙ্গ হবে।
তাই শুরু হল। ইব্রাহীম, সুফিয়া ইব্রাহীম, তার নেতৃত্বে প্রথম ব্যাচ মেয়েদের পাঠানো হল। যে, মেয়েদের ধরবে না (পুলিশ)। এভাবে ২/৩টা টিম যাওয়ার পরে পুলিশ বুঝে গেল, আমরা চালাকী করে হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর ভাঙছি।
তখন পুলিশ মারমুখী হয়ে উঠলো। আমরাও তখন সব একবারে বের হয়ে পড়লাম রাস্তায়। রাস্তায় বের হওয়ার পর আমরা মেডিকেল কলেজ এর মোড়টায়, মেডিকেল কলেজ এর হোস্টেলটা ছিল যেখানে এখন শহীদ মিনার। ঐখানে যাওয়ার পর পুলিশ গুলি করলো। ওখানে কারা কারা মারা গেল তা তো জানেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
জিল্লুর রহমান: সেই দিন প্রত্যেকেরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আন্দোলন আমরা নিয়েছিলাম নাইন্টিন ফোর্টি এইটে আওয়ামী লীগ করে। বলেছি, অধিকারের কথা। বলেছি, অত্যাচার নির্যাতনের কথা, নিপীড়নের কথা বলেছি, কিন্তু মনে মনে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এটিই বাংলার স্বাধীনতার প্রথম স্টেপ। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। কারণ, পাকিস্তান আসলে হিন্দু থেকে আলাদা। তুমি হিন্দু-আমি মুসলমান, আমি তোমার সাথে থাকব না।
আমরা এই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদ, এই বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে এক রাষ্ট্রে নিয়ে এগুতে পেরেছিলাম। কাজেই সেখানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম। তরপরে সেখান থেকে বেরিয়ে ১৯৫৪’র সাধারণ নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা এইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এগিয়ে আসে। কিন্তু সূত্রপাত তো ছিল ’৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
তা ই মাসুম: আপনি তো ভাষা আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন? কীভাবে?
জিল্লুর রহমান: সিন্ধ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল হালিম, তিনি এসেছিলেন ঢাকা। কালচারাল একটা ফাংশন ছিল, কার্জন হলে। সেই মিটিংএ সিন্ধ ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. আব্দুল হালিম বললেন যে, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। শ্যুড বি উর্দু। এর আগের ইতিহাস তো রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ বলেছেন। এইটার বিরুদ্ধে আমরা গিয়ে কার্জন হল আক্রমণ করলাম!
তা ই মাসুম: এটা কবে?
জিল্লুর রহমান: এটা মার্চ এপ্রিলে দিকে বোধ হয় ৫২’র। সিন্ধ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ঐ মিটিং প্রিজাইড করতেছিলেন, সেটা আমি প্রিজাইড করলাম। তারা সব চলে গেল। সব সভা ছেড়ে চলে গেল। এই অপরাধে আমাদের ১০ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১০ জনের মধ্যে আমি একজন।
আমার অবস্থান ছিল, আমার এমএ পরীক্ষা হয়ে গেছিল। ভাইভা পরীক্ষা বাকি। আমারে ভাইভা পরীক্ষায় ডাকল না যে, সে তো ছাত্র না। তাকে এক্সপেল করে দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ আমাকে এমএ ডিগ্রিটা দিল না। তখন বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্রাইক। কঠিন স্ট্রাইক শুরু হয়ে গেল। অ্যাডমিনেস্ট্রেশন যতদিন না মানবে ততদিন স্ট্রাইক চলবে। সেই পরিস্থিতিতে সরকার একটা কম্প্রোমাইজে আসল। আলাপ আলোচনার পর আমাদের দাবি মেনে নিলেন। এবং আমাদের এক্সপালশন উইথড্র করেন। আমরা আবার ফিরে যাই।
তা ই মাসুম: এটা ৫৩’তে আবার উইথড্র করলেন?
জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ, ৫৩’তে উইথড্র করেন। এই হলো আর কি মোটামুটি।
তা ই মাসুম: ৫২’র ২১ থেকে ৭১, ৭১ থেকে ৭৫, ৯০ আবার ২০০৮ এই সময়গুলো কীভাবে দেখেন আপনি? আন্দোলনের এক একটা ধাপ সেখানে, বাংলাদেশ পরিশুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে আবার কলুষিত হওয়ার চেষ্টা করছে?
জিল্লুর রহমান: স্বাধীনতার আন্দোলন করছে বলেন? আমরা কিন্তু নাইন্টিন ফোর্টি নাইনে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করি ২৩ জুন। তখন সে যদিও ছিল যে, আমাদের চাওয়া ছিল বাংলার মানুষের কল্যাণ চাই, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এবং আমরা মনে করি, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম উত্তরণ প্রয়াস। সেখানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হলো। ৫৪’তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, মুসলিম লীগের ভরাডুবি হল। ৬২’তে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন। এই ৬ দফার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সর্ব বিষয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন, কিন্তু ৩টা বিষয়ে স্বাধীন নয়। আর সব বিষয়ে আমরা স্বাধীন। ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে রায় দিল বাংলার মানুষ, বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হল। আমরা পালিয়ে গেলাম।
ঐ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে গ্রুপগুলি যাচ্ছিল, ঐ একটা গ্রুপের মধ্যে আমিও ছিলাম। ধরে নিয়ে গেছিল। প্রথম দিকে ঢাকা থেকে ধরে টঙ্গী, গেন্ডারিয়া এসব এলাকায় নিয়ে ছেড়ে দিত। শেষের গুলি আর ছাড়ল না। ঐ না ছাড়ার দলের মধ্যে আমিও পড়লাম। ৬ দিন ছিলাম।
তা ই মাসুম: স্যার, ৬২/৬৩ বছর হলো, সেই ১৯৪৭ সাল থেকে, এই সময়ে আপনার উপলব্ধি কী? সেখান থেকে এখন একটি বড় রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগের) শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আপনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেছে, নবম জাতীয় সংসদে আপনার দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। আপনার দল আপনাকে বাংলাদেশর রাষ্ট্রপতি করার ঘোষণা দিয়েছে। এই বিষয়টা আপনার কাছে কেমন লাগে?
জিল্লুর রহমান: এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এটা (রাষ্ট্রপতি পদে আসীন না হওয়া) পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত আমি কিছু বলতে চাই না।
তা ই মাসুম: আপনার জন্য শুভ কামনা থাকলো, আপনি ওয়ান ইলেভেনের পর (তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর ক্ষমতা গ্রহণ, জরুরী অবস্থা জারি এবং রাজনৈতিক দল ভাঙ্গার প্রক্রিয়ার মধ্যে) যেভাবে দল টিকিয়ে রেখেছেন, দলকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, এটা কী ভাবে করলেন?
জিল্লুর রহমান: কঠিন কথা বলেছি, তো ওরা ধরতে পারে নাই। কায়দা করে কথা বলেছি।
তা ই মাসুম: আপনি তো বুঝতেন যে, (দলের) কার ভূমিকা কী? আপনার দল, আপনার দল যেহেতু সেই ১৯৪৯ সাল থেকে এই দলের (আওয়ামী লীগ) সাথে সম্পৃক্ত। এখন আপনার দলে যারা আছেন সব তো আপনার পরে যুক্ত হয়েছেন।
জিল্লুর রহমান: ১৯৪৯ থেকে আমি আছি, একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে। যে দিন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়, একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে আমি সেই অনুষ্ঠানে ছিলাম। ভলান্টিয়ার হিসেবে তাদেরকে (আগতদের) পানি খাওয়াতাম। দ্যাট ইজ দ্য স্টার্টিং। এই আর কি, তার পর তো জীবন চলতে লাগল….,পাশ করার পর আমি আইন প্র্যাকটিস করতাম। এরকম চলল ৬২ পর্যন্ত। তার পরে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলাম। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ইন চিফ চিলাম। ছাত্র জীবন গেল, প্রফেশনাল জীবন গেল এভাবে, অনেক কিছু।
আমাকে বঙ্গবন্ধুর আমলে দুইবার আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার আমলে দুইবার জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছি। এইভাবে যাচ্ছে আরকি।
বঙ্গবন্ধুকে মারার পর ৫ বছর জেলে ছিলাম। ফাইভ ইয়ার্স মার্শাল ল’। ৪ বছর জেল খাটার পর বের হইছি। এই তো আর কি!তা ই মাসুম: আমি আজকে আসছি মূলতঃ ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলার জন্য। দেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে, ভাবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাকে সালাম।
জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ (বলে হাসলেন)।
তা ই মাসুম: একটা বিষয়, প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, সামনের কথা বলা যায় না।
জিল্লুর রহমান: বলা যায় না।
তা ই মাসুম: হ্যাঁ, যদি হন, সে দিন প্রচারের (টেলিভিশনে) জন্য দেশবাসীকে আপনার শুভেচ্ছা দিবেন? আর ১/১১’র পরে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, যারাই সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন, তারা বলেছেন, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা। আমি জানি আপনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।
জিল্লুর রহমান: না। ঐ সন্বন্ধে পরে কথা হবে। হু হু হু (মুখ বুজে হাসলেন)। বসে নেই, বসে আবার কথা বলা যাবে। ক্ষমতার ভারস্যাম্যের কথা বলা যাবে। এখনই ক্ষমতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। হা হা হা (হাসলেন) দেখা যাক সেটা বলব পরে।
তা ই মাসুম: আপনার জন্য শুভ কামনা থাকল।
জিল্লুর রহমান: আপনার জন্যও শুভ কামনা। দেবো, আপনাকে ইন্টারভিউ দেবো। আফটার টেকিং ওথ, আপনাকে দেবো।
তা ই মাসুম: প্লিজ। আপনার জন্য শুভ কামনা থাকল, দোয়া করবেন ইনশা আল্লাহ (এই বলে উঠলাম হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলাম)
জিল্লুর রহমান: থাংক ইউ।
চলবে…