পাশাপাশি তিনটি বহুতল ভবন। মাঝের ভবনটির নিচে ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অফিস, ওপরে একটি চাইনিজ রেঁস্তোরা। পাশের দুটি আবাসিক ভবন, বহু পরিবারের বাস সেখানে। আগের ইতিহাস জানা না থাকলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে এই জায়গায়ই ছিল সবুজে ঘেরা একটি দোতলা মনোরম বাড়ি, বাড়ি ভরা ছিল সবুজ গাছ, সামনে ছিল বিশাল লন। ছিল একটি গানের স্কুলও।
সেই বাড়িতে বসবাস করতেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অমর অবদান রাখা এক শহীদের পরিবার। সেই শহীদের নাম আলতাফ মাহমুদ, যিনি সুর করেছেন ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’সহ অনেক কালজয়ী গানের।
স্বাধীনতার পর আলতাফ মাহমুদের পরিবারকে নামমাত্র মূল্যে ১ নং মালিবাগ রোডের ওই বাড়িটি দান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সে বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারেনি আলতাফ মাহমুদের পরিবার। ১৯৮২ সালে ‘জাল দলিল তৈরি করে’ তাদের সে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
যেদিন তাদের বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয় সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে আলতাফ মাহমুদের একমাত্র কন্যা শাওন মাহমুদ সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন: ‘৮২ সালের ফেব্রুয়ারীতে একদিনের নোটিশে সে বাড়িটি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে স্যুটকেসের ওপর মা বসিয়ে রেখেছিলেন আমায়। বসে বসে পুলিশের তাণ্ডব দেখেছিলাম সেদিন। দোতলা থেকে বাবার ব্যাগ ফেলছিল ওরা। এলপি রেকর্ডগুলা চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলছিল বারান্দা থেকে। নীচের তলার সংগীত স্কুলের হারমোনিয়াম তবলা তানপুরা উঠোনের এখান ওখানে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছিল ওরা। আমি জানতাম না রাতে কোথায় থাকবো সেদিন।
বাড়িটির স্মৃতিচারণ করে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ওই বাড়িটির সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। বাবার নামে যে গানের স্কুলটি ছিল সেখানে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার গান শেখানো হত। বাকী দিনগুলোতে সেখানে রিহার্সেল করতো ঢাকা থিয়েটারের কর্মীরা।
সে স্কুল পরিদর্শন করতে অনেক বড় বড় লোকজন আসতো জানিয়ে শাওন বলেন: প্রতি মাসে ওই স্কুলে একদিন শ্রোতার আসর হত। সেখানে ভুপেন হাজারিকা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত লোকজনও আসতেন।
খিলগাঁওয়ের পল্লীমা সংসদে সে স্কুলটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলেও আগের মত আর নেই বলে জানান শাওন মাহমুদ। গান শেখানোর জন্য নেই তেমন কোন যন্ত্রপাতিও। আগের স্কুলের গানের সব যন্ত্রপাতি উচ্ছেদের সময় ভেঙে ফেলে।
ওই উচ্ছেদের পেছনে শাওন মাহমুদ যাদেরকে দায়ী করেন তাদের একজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ যার ‘অবৈধ দখল’ থেকে সম্প্রতি গুলশানের একটি বাড়ি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সরকার।
প্রায় তিন দশক ধরে ব্যারিস্টার মওদুদ গুলশানের যে বাড়িটিতে বসবাস করে আসছিলেন মামলায় জিতে রাজউক সেটির দখল নেওয়ার পর শাওন মাহমুদ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন: সাত্তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ৮২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যেসব উচ্ছেদ কার্যক্রম করা হয় তার মূল রূপকার ছিল সেই সময়েও মন্ত্রী হওয়া এই মওদুদ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও এই কাজে সাহায্য করেছিল মওদুদকে। এমন কি পাকিস্তান থেকে বাড়ির নকল দলিল বানিয়ে এনেছিল ওরা, আমরা অবৈধ বসবাসকারী তা প্রমাণ করবার জন্য।
তবে শাওন মাহমুদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: শাওন মাহমুদের দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ আমি তো তখন সরকারের মন্ত্রী ছিলাম না। এমনকি সরকারের সঙ্গে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতাও ছিল না আমার। এই ঘটনার (আলতাফ মাহমুদের পরিবারকে উচ্ছেদ) সঙ্গে আমার ন্যুনতম কোন সম্পর্কও ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান এবং ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির জন্য আলতাফ মাহমুদকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন বলেও জানান ব্যারিস্টার মওদুদ।
তবে ফেসবুকে এসব লেখার পেছনে তার কোন উদ্দেশ্য নেই জানিয়ে শাওন মাহমুদ বলেন: কোন স্বার্থের কারণে নয়, বা বাড়িটি ফেরত পাওয়ার জন্যও নয়, শুধু সত্যটা জানাতে এবং ভেতরের কথাগুলো বলতে চেয়েছি আমি ওই পোস্টের মাধ্যমে।
১৯৭৩ সালের ২ আগস্ট মওদুদ তার ইংল্যান্ড প্রবাসী ভাই মনজুরের নামে একটি ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে গুলশানের বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নেন বলে মামলায় অভিযোগ করে দুদক। সেই মামলার রায়েই মওদুদকে বাড়ি ছাড়তে হয়।
গত ৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাড়ির মালিকানা নিয়ে রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর ৭ জুন বাড়িটির দখল নেয় রাজউক।