বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সামান্য কয়েকজন সেনাসদস্যদের দ্বারা সংঘটিত কোন আক্রমণ নয়। সুক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি হয়। কারণ, পাকিস্তানি প্রেতাত্মা এবং তাদের দোসররা তখনো ছিল বাংলাদেশে, যারা ঘাপটি মেরে বসেছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিচালিত সরকারের আশেপাশে। প্রথমাবস্থা থেকে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছিল গোপনীয়ভাবে, তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ অনেকেই মোশতাকের ষড়যন্ত্রে রসদের যোগান দিয়েছিল।
স্রোতের বিপরীতে চলা খোন্দকার মোশতাকের জন্য নতুন কিছু ছিল না। মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলায় গঠিত সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করে বেশ কিছুদিন বিষয়টা ঘোলাটে করে রেখেছিল খুনি মোশতাক। সেই থেকে শুরু মোশতাকের ষড়যন্ত্র, শেষ হয় জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধাচরণ করে মোশতাক বলেন, ‘তাজউদ্দিন দেশটাকে বেইচ্যা দিয়ে আসছে।’ একবার চিন্তা করা যায়, মন্ত্রিপরিষদ গঠনের আগেই কূটচাল শুরু করে খুনি ঘাতক মোশতাক। এখন আর বুঝতে বাকি নেই, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিনের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল মোশতাক গং। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পর থেকে সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পেছন পেছন লেগে থাকত খন্দকার মোশতাক। মোশতাকের প্রাথমিক ও চুড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, যেকোন মূল্যে শেখ মুজিবকে নিশ্চিহ্ন করা, যে জন্য তিনি কারণে অকারণে শেখ মুজিবের সাথে ছায়ার মত লেগে থাকতেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, ‘বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যু হলে স্টিমার ভাড়া করে টুঙ্গিপাড়া যায় পুরো পরিবার। সেখানে অন্যদের যাওয়া নিষেধ ছিল, কেউই যায়নি কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর অবগত হলেন সবাই; লঞ্চে মোশতাক এক কোণে চাদর মুড়ি দিয়ে বিষন্ন মনে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে আছে’। সে সময় থেকে মুজিবের সব খবরাখবর দোসর গোষ্ঠীদের কাছে হস্তান্তর করাই ছিল খোন্দকার মোশতাকের উদ্দেশ্য। কি রকম হায়েনা মোশতাক! বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার রদ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিচারের রাস্তা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সে অধ্যাদেশ সংবিধানে যুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাকে হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে যারা আন্দোলন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তৎকালীন সরকারগুলো।
বঙ্গবন্ধুর বাস্তবমুখী ও সামাজিক উন্নয়নের বিকাশমান পদক্ষেপ স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, পাকিস্তানি প্রেতাত্মা ও দেশি বিদেশি শোষক শ্রেণির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, ষড়যন্ত্রকারী ও বিপথগামীদের সম্মিলিত আক্রমণে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা, দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল, দুই পুত্রবধূ, শিশু পুত্র শেখ রাসেল, শেখ নাসেরসহ ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতি এ হত্যাকাণ্ডের দায়ভার কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ করতে পারবে না। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে সামরিক সরকারের আমলে অনেক সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে থেকে যারা বিচার চেয়েছে তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে আহুত নানা রকমের সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্ভূত ক্যুগুলো দূরীকরণের জন্য সেনাবাহিনীর চৌকস সদস্যদের কোন বিচারের আওতায় না এনেই হত্যা করা হয়।
বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক কলঙ্কময় অধ্যায় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতির কবিকে হারানোর মর্মবেদনায় বিভোরের দিবস। সেই আগস্টের মুমূর্ষ সময়েও অর্থ্যাৎ জীবনের অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছায়ার মত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদরের রেণু। ঘাতকের সামনে বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, “উনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেলো”। জীবনের প্রতি মায়া ছিলোনা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া। ফজিলাতুন নেছার ধ্যান-জ্ঞান ছিল দেশ এবং দেশের মানুষ। ঐদিনের সেই নিষ্ঠুর পরিবেশে একটিবারের জন্যও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে কল্পনায় আনতে পারেননি বাঙালি জাতির গর্বের ধন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। নিজের জীবনকে আড়ালে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতের সামনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
ফজিলাতুন নেছা তাঁর আপন মহিমায় স্বামীর প্রতি নিজের জীবনকে নিবেদন করেছিলেন। তাই তো নিষ্ঠুর মরণও তাদেরকে আলাদা করতে পারেনি।
পরিবারের সদস্যদের রেখে নিজে পলায়নের চেষ্টা করেননি কখনো। তিনি নিজে হয়ত চিন্তা করেছিলেন, যে প্রিয় স্বদেশে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে সে দেশে বেঁচে থেকে আর কি হবে। বঙ্গবন্ধুর অস্থিমজ্জাকে তিনি নিজের অস্তিত্বের পরিপূরক মনে করেছিলেন। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পর থেকে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর চেতনা আর রাজনীতিকে ধারণ করতেন নিজের অস্তিত্বে, মেধা ও মননে। ফলে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে, সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাইতো, ফজিলাতুন নেছা বাঙালির মণিকোঠায় এবং রাজনীতির সংবিধানে অমরত্ব লাভ করেছেন। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল তাবেদার সরকার ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে। সামরিক সরকারের ক্ষমতা দখল, একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে, অসংখ্যবার সংঘটিত ক্যু বাঙালির সত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে বাঙালির মুক্তি, মুক্তচিন্তা, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র ছিল না তখনকার পরিচালিত সরকারগুলোর মাঝে।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পরে ঘাতকদল লাশ দাফনের সময়ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। সেদিন নিহতদের লাশ প্রথমাবস্থায় ট্রাকে করে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, ট্রাক থেকে টুঙ্গিপাড়া নেওয়ার জন্য যে মৃতদেহটি নামিয়ে রাখা হয় তা ছিল বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরের। কিন্তু মরদেহ দাফনের প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিলো সেদিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, লাশ আনা নেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাকর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশটি টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে নেওয়ার ব্যবস্থা করে শেখ নাসেরের মৃতদেহটি অন্যান্যদের সাথে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। খুব নাটকীয়ভাবে খুনী ও তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহটিকে গুম করার চেষ্টা চালিয়েছিল। তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের আদর্শের প্রতীক হয়ে বেঁচে রইবেন মানুষের অন্তরে, মনের মণিকোঠায়।
সম্প্রতি জাতিসংঘে শোকদিবসের আলোচনায় বক্তারা বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেন। যাই হোক, বঙ্গমাতার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ফজিলাতুন নেছাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করেন এবং এখনো কয়েকজনের শাস্তির রায় কার্যকরের অপেক্ষায়। কতটা ঘৃণ্য ও নারকীয় মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল ঘাতকদল। তাঁরা বুঝতে পেরেছিল, কোনভাবে যদি বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহকে আড়াল করে রাখা যায় তাহলে একসময় এ লৌহ মানবের চেতনা ও ব্যক্তিত্বের বিশালতাকে মুছে দেওয়া যাবে। কারণ, ঘাতকদল বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনার বিকাশমান ঘটাতে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হবে। এ সময় যদি বঙ্গবন্ধুর কবরস্থান ঘিরে কোন নাটকীয়তা হয় সে সুযোগটা পুরোটা লুফে নিবে দেশবিরোধী চক্র। কিন্তু সে রকম কোন জটিলতা তৈরি হয় নাই এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ শুরু করে।
যদিও এ বিচার কাজ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সরকারকে দেশি বিদেশি নানা রকমের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অধিষ্ঠিত সরকার বাংলাদেশের চরম শত্রুদের বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। কয়েকজনের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে, বাকিদের বিচার (দেশের বাইরে অবস্থানরত) কার্য দ্রুত শেষ করার জন্য সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
চলবে…