২৫ মার্চ সকাল থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে সারা দেশে। কারণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার যুদ্ধের সকল ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলেছিল। বঙ্গমাতা সবকিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি যে বাড়ি থেকে তৈরি হয়, সে বাড়ির বড় ছেলে শেখ কামালকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুভযাত্রা করেন ফজিলাতুন নেছা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলার আকাশে দুর্যোগের বিভীষিকা ছিল এবং সর্বাধিক দুর্যোগময় রাত্রি দর্শন করেছে বাঙালি জনগোষ্ঠী। ২৫ মার্চের সে বিভীষণ রাত্রিতে ৩২ নম্বরের জনবিরল বাড়ি সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে অন্যদিনের ন্যায় একটু তাড়াতাড়িই জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ফজিলাতুন নেছা, জামাল, রেহানা, রাসেল আর নিত্যদিনের কাজের সঙ্গী আব্দুল, রহমান, ফরিদ আর বুয়া। শেখ কামাল ছিলেন ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে ব্যারিকেড নির্মাণে ব্যস্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে স্বামীর সংসারে ছিলেন। ঐ দিনই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে আর্তচিৎকারে ভেসে আসছিল মানুষের কান্না, ঢাকা শহরকে লণ্ডভণ্ড করেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা।
সেদিনের সে কালরাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ব্যক্তি বিশেষের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি ছাড়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিছুতেই বাড়ি না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহধর্মিণী রেণুও বঙ্গবন্ধুকে না ছেড়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির চতুর্দিকে অবিশ্রান্ত ধারায় গুলি বর্ষিত হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের দিক থেকে। সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের কথা জানালে ফজিলাতুন নেছা মুজিব সাথে সাথে স্যুটকেস সাজিয়ে দিলেন প্রিয় মানুষটিকে যেখানে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও ঔষধ-পথ্যাদি ছিল। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হল, নিয়ে যাওয়া হল পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে। অবশ্য গ্রেপ্তারের পূর্বে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাসহ নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ধরণের দিক-নির্দেশনা দিয়ে যান। সন্ধ্যার পর থেকে দফায় দফায় বঙ্গবন্ধু তার সিপাহশালারদের সাথে বৈঠক এবং ফোনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু সবকিছুর পূর্ব প্রস্তুতি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, বাকি ছিল কেবল নিজ পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে নতুন করে আবার বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হন ফজিলাতুন নেছা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর বেগম মুজিবের সাথে যে কয়েকজন সাংবাদিক সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন তাদের মধ্যে ত্রিপুরার রবীন সেনগুপ্ত, ভূপেন চন্দ্র ভৌমিক এবং অনিল ভট্টাচার্য অন্যতম। ত্রিপুরার চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে কথোপকথনের বিভিন্ন পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের কথা জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে বেগম মুজিব বলেন সে সময়কার বিশেষ করে ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহ চিত্র ও নির্যাতনের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন যার ভাষান্তর মোটামুটি নিম্নরূপ:
“২৫ তারিখ রাতে মিলিটারিরা বাসায় এসে ঘেরাও করল আর গুলি চালানো শুরু করল। শেখ সাহেব তখন শোওয়া ছিলেন। গুলির আওয়াজে শেখ সাহেব, আমি ও আমার ছোট ছেলে বাথরুমের ভেতর চলে যাই। ওরা যখন আসছে, তখন প্রথম থেকেই ওরা গুলি করতে করতে আসছে। জানালা খোলা ছিল। আমি জানালা বন্ধ করতে গেছি। জানালা বন্ধ করতে যখন গেছি তখন দেখি পাশের বাড়িতে মিলিটারি ঢুকছে। ওটা দেখে শেখ সাহেবকে তাড়াতাড়ি করে ডাক দেই যে মিলিটারি আসছে। শেখ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন; কী করে জান তুমি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, মিলিটারি আসছে। এর ভেতরে আমি মিলিটারির আওয়াজ শুনতে পাই। ‘জোয়ান পজিশন নাও’ যেই এই কথা বলছে, আমার ছেলে তখন অন্য ঘরে শোওয়া ছিল। আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে মেজ ছেলেরে নিয়ে আসি। আমি দরজা বন্ধ করতে পারি নাই। এর ভেতর উপর নিচ সব জায়গায় শুধু গুলির আওয়াজ। শেখ সাহেব বাথরুম থেকে বের হয়ে ওদের বলল গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর।
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। তারা এত গুলি করছে যে, আমাদের ভেতরের কথা তারা কিছুই শুনতে পায়নি। আমার একটি ছোট ছেলে আছে (রাসেল)। ওই ছেলেটা খুব ভয় পেয়ে গেছে ও খুব কান্নাকাটি করছে। ওরে আমি ঘরের ভেতর আনতে পারি নাই। ও অন্য ঘরে শোয়াছিল। তারা ছেলেটিকে বলল তুমি আম্মার কাছে যাও।
এ ভেতরে শেখ সাহেব চিৎকার করে বললেন ‘স্টপ ফায়ারিং’। এই কথা বলার পর গুলি বন্ধ হয়ে গেল। এর আগে আমার বেডরুমের ভেতরে অনেক গুলি করা হয়েছে। তারপর শেখ সাহেব বাইরে বের হয়ে আসলেন। আসার পর বললেন, তোমাদের এখানে বড় অফিসার কেউ আসছে? ওরা কী বলল আমি আর শুনতে পাই নাই। আমি তখন ভেতরের রুমে বসা আছি। তারপর শেখ সাহেব ওদের সাথে নিচে চলে গেলেন। নিচে গিয়ে একটু পর আবার উঠে আসলেন। কর্নেল বোধ হয়, একজন মেজর, ২ জন সিপাহী উনার সাথে উপরে আসল। উপরে এসে জামালকে বলল, আমার কাপড় চোপড় আর স্যুটকেসটা দাও। তাড়াতাড়ি করে আমি আর কামাল জামা কাপড় রেডি করে দিলাম।
শেখ সাহেব কর্নেলকে বললেন, ‘আপনারা আমাকে ফোন করলেই তো পারতেন এভাবে গুলি চালানোর কী উদ্দেশ্য’? যখন শেখ সাহেবকে নিচে নিয়ে যায়, তখন কর্নেল মেজ ছেলেকে বলল, ‘তোমার বাবারে নিয়ে যাচ্ছি আমি খুবই দুঃখিত’। মেজ ছেলে খুব রাগ করল। শেখ সাহেব বললেন এদের সাথে কথা বলে আর কী হবে”? রবিন সেনগুপ্ত বেগম মুজিবকে আরও জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘শেখ সাহেব আপনাকে সর্বশেষ কী বলে গিয়েছিলেন’?
এর উত্তরে বেগম মুজিব বলেছিলেন- এখানে যদি তুমি ভালভাবে থাকতে না পার, দেশের বাড়িতে চলে যেও। এরা (ছেলেমেয়ে) থাকলে এদের ভালভাবে লেখাপড়া শিখাবে। এই একটি মাত্রই কথা, ছেলেমেয়ে থাকলে ওদেরকেই মানুষ করবা। আর কোন কথা বলেননি। এরপর তিনি নয় মাস আতঙ্কের দু’একটি কথা বলেন, টেপে যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা বোঝা যায় না। তবে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
চলবে…