একেবারে একটি শূন্য অবস্থান থেকে বিশাল রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া এবং একটি দেশের আপামর জনগনের আশাভরসার প্রতীক হয়ে ওঠা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আজ একাত্তরতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বাংলার মাটিতে জন্ম নেয়া এক হিরন্ময় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাজীবনের ত্যাগ তিতীক্ষা সংগ্রাম সততার ফলে আমরা একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। এই আওয়ামী লীগ দলটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু ত্যাগ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতা এনে দিয়েও মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে বাংলার মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে এনেছিল জাতির পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ। প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন টাঙ্গাইলের মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে বন্দী ছিলেন।
পাকিস্তানে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ জুন বিকেলে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্যে জনসভা করে। সভায় আনুমানিক প্রায় চার হাজার লোক উপস্থিত হয়। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
তারপর থেকে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাঙ্গালির স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় সমগ্র পাকিস্তানে। কিন্তু পাকিস্তানিরা তা মেনে নেবে কেন? ফলে ইতিহাসের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমাদের দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের আজ ৭১ বছরে পা দিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশকে এখন এগিয়ে দেয়ার নেতৃত্বে আছে দলটি। তাদের সুযোগ্য নেতৃত্বে যেমন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে তেমনই এখন বিশ্বসভ্যতার উন্নত দেশগুলোর কাতারেও সামিল হচ্ছে। আমরা দলটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।