হ্যানয়তে তিন রাত কাটানোর পর এলো বহু কাঙ্ক্ষিত সেই হা লং বে যাবার পালা। আমাদের পরিকল্পনা ছিল দুই দিন এক রাত থাকবো। সেইমতো সবকিছু ঠিক হলো। ঢাকা থেকেও হা লং বে ট্রিপের জন্য বুকিং দেয়া যেতো। কিন্তু আমরা ভিয়েতনাম যেয়ে সবকিছু ঠিক করতে চেয়েছি। আমাদের এই ভাবনাটা কার্যকর ছিল। কারণ হা লং বে যাওয়ার জন্য আবহাওয়া ঠিক থাকা জরুরি। ওখানে বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। যেদিন হ্যানয়তে পৌঁছালাম, সেদিনই একটি ছোট টাইফুন ভিয়েতনাম অতিক্রম করেছে। আবহাওয়া ঠিক হওয়ার অপেক্ষায় আমরা হা লং বে যাওয়া একদিন পিছিয়ে দিলাম।
সফরের চতুর্থ দিনে হা লং বে যাওয়ার জন্য এজেন্সির কাছে ট্রিপের বুকিং দিলাম। মহামান্য রাষ্ট্রদূত আপার নির্দেশনায় এই এজেন্সির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন হ্যানয়তে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মি. তিয়েন। বাংলাদেশ থেকে দূতাবাসের যত অতিথি হ্যানয় সফর করেন তাদের সযত্ন দেখভাল করেন এই মি. তিয়েন। তিনি গত ২০ বছর বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত।
হ্যানয়তে হোটেলের পাট চুকিয়ে সকাল সাতটায় হা লং বে’র উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। দুই ঘণ্টার জার্নি। মিনি ট্যুরিস্ট বাসে আমরা মোট ১৯ জন। বিভিন্ন দেশের নাগরিক আমরা। বাসে ওঠার সময় খেয়াল করলাম, সবচেয়ে বড় গ্রুপটি ৫ লিটারের বোতলে করে খাবার পানি সঙ্গে নিয়েছে। বুঝলাম, আমাদের সঙ্গেও অতিরিক্ত পানি নেয়া উচিত ছিল। পরে আবিষ্কার করলাম, ক্রুজ শিপে সব খাবার প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পানি বা পানীয় কিনে খেতে হয় চড়া মূল্যে। ভুল যা হবার হয়েছে, কিছু বাড়তি কড়ি গুণতে হলো আর কী!
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ট্যুরের ব্যবস্থাপনা খুব সুশৃঙ্খল। ট্যুর গাইড কিন্তু একজন নন। মিনিবাসে একজন ছিলেন। শিপে ওঠার সময় আসলেন আরেকজন, মিস্টার টমি। এটা তার আরোপিত নাম। ভিয়েতনামী নাম ট্যুরিস্টরা সহজের মনে রাখতে পারেন না সে কারণে গাইড নিজের নাম দিয়েছে টমি। বয়স ২৪-২৫ বছর হবে। খুবই চটপটে যুবক। কর্মঠও।
শিপে ওঠার বেশ আগেই মিনিবাসের জানালা দিয়ে হা লং বে’র জলরাশি চোখে পড়ছিলো। বর্ণনা করে সে দৃশ্য বোঝানো সম্ভব না। ছবি দেখেও তার সৌন্দর্য অনুধাবন করা সম্ভব না। কেবল চোখের ক্যামেরায় ধারণ করে বাকি জীবন তারিয়ে তারিয়ে দেখার মতো দৃশ্য। সেই দেখায় চোখে প্রশান্তি আসে। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। উপসাগরের শান্ত সবুজ জলের বুকে ছোট ছোট পাহাড় বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আবার কোনোটার সঙ্গে কোনো পাহাড় গায়ে গায়ে লেগে আছে। পাহাড় তো নয়, যেন একেকটা বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড। পাথরের ভাঁজে ভাঁজে ছোট আকৃতির সব গাছ।
প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মিনিবাস থেকে নেমে শিপে উঠলাম। শিপ যাত্রা করার সময়েই মি. টমি আমাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন। আমরা ওই দিন কি কি করবো, কতক্ষণ পর লাঞ্চ করবো সেসব বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন। আমাদের কাছেও জেনে নিলেন কার কী সমস্যা আছে। খাবার-দাবারে কার কোনটায় আপত্তি। এরপরই আমাদের নিজ নিজ রুমের চাবি বুঝিয়ে দিলেন।
জাহাজের লিভিং রুমে সবাই জড়ো হওয়ার পর খেয়াল করলাম আমাদের ছেলে ফিদেল দলের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য। ফিদেলের বাবা আর আমি বয়োজ্যেষ্ঠ। বাকিদের বয়স গড়ে ২৪-২৬ বছর। সে সময়ে আবার অনুধাবন করলাম শারীরিক সক্ষমতা বেড়ানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সক্ষমতা হারালে অর্থ-বিত্ত প্রকৃতি দর্শনে তেমন কাজে লাগে না। তাই যাদের বেড়ানোর নেশা আছে তারা অর্থ সঞ্চয়ের পর বেড়ানোর পরিকল্পনা করে থাকলে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের দলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এক নবদম্পতি ছিল। মালয়েশিয়া থেকে এসেছেন আরেক মার্কিন নাগরিক। তিনি মালয়েশিয়ার স্কুলে ইংরেজি শিখান। ছুটি পেয়ে বেড়াতে চলে এসেছেন। সবচেয়ে বড় দলটি ছিলো ১০ জনের। তারা লেখাপড়া করে। গ্রুপটিতে কোরিয়ান, ভিয়েতনামীসহ কয়েকটি দেশের ছেলেমেয়ে ছিল। সবচেয়ে জমজমাট গ্রুপ ছিল এটি। কানাডা থেকে আসা দুই বান্ধবীও ছিলেন।
মি. টমির কাছে জানলাম, লাঞ্চের পর আমরা হা লং বে তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য পাহাড়ের একটিতে আবিষ্কৃত গুহাতে। জাহাজে শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে বসতেন মার্কিন এক নবদম্পতি। লাঞ্চের সময় স্মোকড তেলাপিয়া মাছ খেতে গিয়ে আমি তো বেআক্কেলের কাজ করে ফেলেছিলাম! আস্ত মাছ থেকে একটু একটু করে খাচ্ছিলাম সবাই। এক পাশে খাওয়া শেষ হলে সবার সুবিধার জন্য মাঝের কাটাটা আমি বোন প্লেটে ফেলার জন্য কাটা চামচ দিয়ে ধরেছি, আচমকা সেই মাছের কাঁটা গিয়ে পড়লো পাশে বসা মার্কিন ভদ্রলোকের পায়ে। আমি ভীষণ লজ্জা পেলেও ভদ্রলোক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিলেন। ভদ্রলোক বলে কথা। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাকে স্বাভাকি করার চেষ্টা করলাম। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আর নিজেকে গাধা বলে বকা দিলাম। লাঞ্চে খাবার মেনুতে স্কুইড ছিল। ফিদেলের জন্য এটি নতুন খাবার। স্কুইড খেয়ে বলে, এটা তো পাস্তার মতো! মেনুতে আরো ছিল উপাদেয় সালাদ, বিফ। যথেষ্ট পরিমাণ স্টিকি রাইস আমার পাশের ভদ্রলোক সয়াসস দিয়েই খেয়ে ফেললেন!
হালং বে’র পাহাড়গেুলোতে বেশ কয়েকটি গুহা রয়েছে। আমরা সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টিতে গেলাম। আমাদের গুহা অভিজ্ঞতা এই প্রথম। বিশাল সেই ‘সুং সট’ গুহাকে ট্যুরিস্টদের জন্য কিছুটা আলোকিত করা হয়েছে অনেকগুলো লাইট স্থাপন করে। গুহার প্রবেশ মুখে হাজারো পর্যটকের ঢল। প্রচণ্ড গরম থেকে গুহার ভিতরে প্রবেশ করতেই বাতাসের শীতল পরশ! উপরে এবং নীচে এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে ভূমি দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে চলেছি বা সিড়ি ভাঙ্গছি একটার পর একটা। দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের সুযোগ কম। কারণ সামনে এবং পেছনে অসংখ্য মানুষ। এর সঙ্গে রয়েছে ফিদেলের তাড়া। গাইড যেহেতু সময় বেঁধে দিয়েছে, সেহেতু এক মিনিটও দেরি করা যাবে না। তার মনে ভয়, দেরি করলে গাইড যদি আমাদের ফেলে জাহাজে চলে যায়! তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে আমাদের ফেরার উপায় কী হবে! কোনো যুক্তিতেই সে বুঝতে চাচ্ছিলো না যে, গাইড আমাদের ফেলে যাবে না। ফিদেলের তাড়ার মধ্যেই ডানে-বায়ে, উপরে-নীচে বিস্ময়ে তাকাতে তাকাতেই গুহার শেষ মাথায় পৌঁছে গেলাম একটা সময়ে।
গুহা থেকে আবিষ্কার করলাম, আমরা দ্বিতীয়। আমাদের আগে শিক্ষক ভদ্রলোক জেটিতে পৌঁছেছেন। অন্যদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। মার্কিন ভদ্রলোক ঘেমে-নেয়ে একাকাকার। আমাদের মতো তিনিও পিপাসার্ত। জাহাজ থেকে খাবার পানি সঙ্গে নেননি। পরিচয় পর্ব দিয়ে তার সঙ্গে আমাদের আলাপ শুরু। সজলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার পর সে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমি হ্যালো বলে অন্যদিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেছি। ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি দেখিইনি। সজল সেটা জানানোর পর সরি বলে হ্যান্ডশেক করলাম। শিক্ষক ভদ্রলোক জানালেন, তিনি বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। কারণ মালয়েশিয়ায় মেয়েদের কেউ কেউ হ্যান্ডশেক করে। আবার কেউ কেউ করে না। আমাকেও সেই না এর দলে ভেবে নিয়েছেন।
চলবে