সব চাইতে ধারালো অস্ত্রের প্রতিযোগিতা চলছে। কারও তলোয়ার লোহা কাটছে মাখনের মতো। কারও বর্শা গাছের গুঁড়ি ফুঁড়ে দিচ্ছে। এক তাগড়া পালোয়ানকে দাঁড় করিয়ে এক ওস্তাদ তলোয়ার ঘোরালেন। সে তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। ওস্তাদ ধমকে বললেন, বেয়াদব- কুর্নিশ করো। সে যেই ঝুঁকল, অমনি মাথাটা পড়ে গেল খসে। ওয়াহ ওয়াহ করে ওস্তাদকেই খেতাব দিতে যাবেন নবাব, এমন সময়ে রোগা-পটকা একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল। সঙ্গে তার বিবি, পুরো মুখ ঢাকা। জাঁহাপনা, সব চাইতে ধারালো অস্ত্র দেখে নিন, বলেই বিবির মুখমণ্ডলের কাপড় খুলে দিল সে। লম্বা জিভ বের করে দিল বিবিজান। খেতাব নিয়ে গেল রোগা লোকটাই। মেয়েদের জিভের চাইতে ধারাল অস্ত্র হয় নাকি?
আমরা যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখনও মেয়েদের নিয়ে এ ধরনের জোক বলতাম। শুনতাম। এখনও শুনি। নারীদের হেয় করে, তাদের নিয়ে রঙ্গরস করে আলাপ না করলে পুরুষের আড্ডা জমে না। শুধু যে মজা বা তামাশা করার জন্য এসব বলা হয় তা কিন্তু নয়, এসবের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি বিদ্বেষও ফুটে উঠে। মেয়েরা কান ঝালাপালা করে সর্বক্ষণ, তাদের কথার খোঁচায় পুরুষেরা নাকি সর্বদা অঙ্গার হয়। মেয়েদের নামে যত দুর্নাম চলে আছে, এটা তার মধ্যে সব চাইতে পপুলার। কারণ, সব চাইতে ভুল। মেয়েদের কোনও কথায় যে কান দিতে নারাজ পুরুষেরা, ‘তুমি থামো তো’ বলে ধমক দেওয়াটাই যে রীতি। মেয়েদের শক্তি-সামর্থ্য ভোলাতেই এসব পাতি রসিকতা।
কিছু কিছু মানুষ এখনও ত্যাড়া-তক্ক জুড়ে দেন, নারী দিবস কেন? কোনো পুরুষ দিবসতো নেই। দিবস যদি পালন করতে হয়, তবে মানব দিবস পালিত হোক! পুরাই মানবতাবাদী! অনেকে পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করার কথাও তোলেন। ঢাকার একজন আলোচিত এমপি হাজি সেলিমতো একবার সংসদে পর্যন্ত বিষয়টি তুলেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে যারা নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখেননি, মূলত তারাই এ অহেতুক বিতর্কগুলো অবতারণা করেন। যুগ যুগ ধরে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে করতে ক্ষমতা-দাপট-কর্তৃত্ব দেখাতে দেখাতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, এর একটু হের-ফের দেখলেই তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। নিজেকেও বঞ্চিত মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়েন নারীর ওপর!
দেশ শাসনের জন্য, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার যেমন কিছু আইন-নীতি তৈরি করে, সমাজ ও পরিবারে নিজেদের দাপট অক্ষুণ্ণ রাখতে পুরুষরাও কিছু নীতি-আইন তৈরি করেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব নিয়ম-নীতি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। পুরুষের তৈরি এসব নিয়মনীতিই পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্রই হচ্ছে নারীকে অধস্তন রাখার হাতিয়ার।
কোন এক জায়গায় অনেক মানুষের মধ্যে কোন নারী উচ্চস্বরে কথা বলে উঠলে তাকে কিভাবে কোণঠাসা করা হয় দেখেছেন? সবাই কিভাবে চেঁচিয়ে ওঠে লক্ষ্য করেছেন? বাসে দাঁড়িয়ে যেতে চাইলেও শুধু নারী বলেই একজনকে নেওয়া হয় না, পুরুষের বেলায় যদি এমন হতো, শুধু পুরুষ বলে নেওয়া হবে না, তখন সমাজে এর কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো?
প্রতিটি পদে পদে পুরুষতান্ত্রিক অবিচারের শিকার নারীরা। অবশ্য এখানে শুধু একজন পুরুষ বা একজন নারী এভাবে বিচার করলে ভুল হতে পারে। কারণ, সবাই ওই পুরুষতন্ত্রের পুতুল। ‘অমুক পুরুষ বলেই এমন কাজটা করতে পারলো’ বা ‘নারী হয়ে নারীর বিরুদ্ধে এমন কাজ করলো!’-এখানে দুজনই প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক-রীতিনীতর ক্রীড়নক। অধিকাংশ নারী-পুরুষ না বুঝেই পুরুষন্ত্রের গোলামী করে।
একটা কথা ঠিক, শুধু নারী হলেই সে বঞ্চিত আর পুরুষ হলেই অত্যাচারী-ব্যাপারটা তেমন সরল নয়। আসলে নারী বা পুরুষ যেই হোক, সে সমাজের কোন শ্রেণির সদস্য, ক্ষমতার স্পেক্ট্রামের কোন জায়গাটিতে তার অবস্থান- সেগুলো দিয়ে নির্ধারিত হয় কে কাকে কতটুকু অত্যাচার বা শোষণ করতে পারবে বা করে। এটা নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে এটা মানতে হবে যে, নারীরা অন্তত আমাদের দেশে অনেক বেশি নিগৃহীত এবং সংখ্যাটা আশঙ্কাজনক।
পরিস্থিতি অবশ্য বদলাচ্ছে। পুরুষরা চালাকি দিয়ে যে ‘ক্ষমতা’র জগৎ গড়েছে, সেই জগৎ একটু একটু করে ধ্বসে পড়ছে। নারীর অগ্রযাত্রার ঢেউয়ে পুরুষতন্ত্রের পালোয়ানি স্তম্ভগুলো খসে খসে পড়ছে। পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ মিলে ‘মার্কেট’ নামক ভোগবাদের যে ফাঁদটি তৈরি করেছে, সেই মার্কেটেও নারীরা ‘খবরদারি’ করতে শিখেছে। ‘মার্কেট’ বড় কঠিন জায়গা। বিপণনের একমাত্র শর্ত সাফল্য। হাজার নীতিকথা সেখানে আঁচড় কাটতে পারে না। সেখানেও এখন মেয়েদের অপছন্দ প্রাধান্য পাচ্ছে। ফর্সা হওয়ার ক্রিম এখন আর মেয়েদের বিয়ের টোপ ফেলছে না, বিউটি কুইন হওয়ারও নয়। ফর্সা হওয়া এখন নাকি ‘কনফিডেন্স’-এর জন্য। প্রত্যয়ী মেয়েটি বাবাকে বলে, আরও তিন বছর পর বিয়ে করব, যখন সুপাত্রের সঙ্গে ‘ইকোয়াল-ইকোয়াল’ হব ডিগ্রি, চাকরিতে। স্যানিটারি ন্যাপকিন থেকে হিরের গয়না, সর্বত্র ‘অ্যাচিভার’ মেয়েদের সামনে রাখা হচ্ছে জিনিস বিক্রি করতে। এক দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েলিপনা-সর্বস্ব বিপণনের প্রতিবাদ করে যে মেয়েরা ব্রা পুড়িয়েছিলেন, যা ছিল নারী আন্দোলন দানা বাঁধার অন্যতম মুহূর্ত, আজ তারা থাকলে কি করতেন? হয়তো হাসতেন! সেদিন বিজ্ঞাপন মেয়েদের বলে দিত, মেয়েদের কেমন হওয়া চাই। আজ মেয়েরা বলে দিচ্ছে, বিজ্ঞাপন কেমন হওয়া দরকার!
মার্কেটের মতোই কঠিন জায়গা হচ্ছে পলিটিক্স। এতদিন ধরে সরকার মুখে সহানুভূতি দেখিয়ে মেয়েদের পাতে এটা-ওটা তুলে দিতে চেয়েছে। একটা-দুটো ‘খোঁড়া’ আইন, কিছু বৃত্তি-উপবৃত্তি, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদে মেয়েদের জন্য কিছু সংরক্ষিত আসন। এটুকুই। রাজনীতির মূলধারায় আসতে তাদের জন্য পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারে একজন নারী নির্বাচিত হলেও কোন ক্ষমতা তার হাতে থাকে না। কারণ চেয়ারটি বাঁ হাতে ঠেলে দিলেও, মেয়েদের কথা শুনতে এখনও অনেকে রাজি নয়।
বদলটা এখানেও হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ভোটে নারীরা জয়ী হচ্ছেন। রীতিমত প্রতিযোগিতা করে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিচ্ছেন। নারীদের দাবিগুলো উঠে আসছে রাজনৈতিক দলের ইস্তেহার, লিফলেটে। মিডিয়ায় একেবারে উপর দিকেই থাকছে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগার, রান্নার গ্যাসের ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন বৃহত্তম দলগুলোরও এজেন্ডা। এক সময় পাঠ্যপুস্তকে কেবল ছেলেদেরই জয়-জয়কার ছিল। শক্তি-সামর্থ্য-সাফল্যের কোন কিছু বোঝাতে কেবল ছেলের ছবি ব্যবহার করা হতো। এখন বলা হচ্ছে: এ ছবি ভুল। এমন হওয়ার কথা নয়। মেয়েরা ঘরগৃহস্থালির কাজ করছে, সেবাধর্মী কাজ করছে-এমন ছবি ব্যবহার করা চলবে না। মেয়েরা খেলছে, পর্বতে উঠছে, বিমান চালাচ্ছে, প্রশাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে-এমন ছবি দিতে হবে। ‘খোকার সাধ’ মার্কা কবিতা লেখা চলবে না। বলতে হবে ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা।’ ছেলে বড় নয়, মেয়ে ছোট নয়। সমানে সমান। এই চেতনা, এই ভাবধারা সমাজে ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। রাষ্ট্রও এখন ‘নারী-পুরুষ সমতা’র নীতিকে সামনে আনতে বাধ্য হচ্ছে। রাষ্ট্রের কানেও একটু একটু করে জল ঢুকছে। ছয় দশক লাগল নেতাদের কানে জল ঢুকতে। কানটা খুলে রাখলে আর একটু আগেই বোধোদয় হত।
মজা হল, নারীরা যে দল পাকিয়ে মিছিল করে স্লোগান তুলে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে উল্লিখিত চাহিদাগুলোর জন্য, এমন নয়। অথচ মেয়েদের এ কথাগুলো না শুনলে ভোট কমবে, রাজনীতির অতি পোড়-খাওয়া, নীতি-উদাসীন নেতাদের কাছেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ পণ্যের বাজারে বিক্রি, নির্বাচনের বাজারে ভোট, দুটোই কমতে পারে মেয়েদের কথা না শুনলে।
হে পুরুষ, তোমার ঘাড়ে একটাই মাথা। তাতে দুটো কান। সে দুটো খোলা রাখো। নারীদের কথাগুলো শোনো। আর তার চর্চা শুরু হোক নারী দিবসে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)