চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘হে ধর্ষিতা, তুমি জান, শরীর কোথায় শেষ হয়…’

২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ হিসেবে পালন করা হয়। পৃথিবীব্যাপী নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা যখন নারী নির্যাতন বন্ধ করতে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ব্যস্ত, ঠিক তখন বাংলাদেশের জামালপুর জেলায় এক স্কুলছাত্রী দলগত ধর্ষণের শিকার হয়ে সংবাদমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হন। খবর মতে, রাস্তা থেকে ফিল্মি কায়দায় তুলে নেয়ায় পর স্কুলছাত্রীকে পাঁচ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। এরপর দুর্বৃত্তরা মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে যায় রেল স্টেশনের কাছে। এখন ওই মেয়েটিকে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেও বাধা দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। দলগত ধর্ষণের শিকার নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুরের এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান!

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৯জন নারী ধর্ষিত হয়। যা শেষ পর্যন্ত পুলিশ রিপোর্টে নথিভুক্ত হয়। প্রকৃত সংখ্যাটা সম্ভবত এর দশ গুণ, কেননা ৯০ শতাংশ ধর্ষণই লোকলজ্জায় কিংবা পরিবারের অমতে গোচরে আনা হয় না। এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণকাণ্ডের যারা শিকার, তাদের সাড়ে বারো শতাংশই নাবালিকা, অনেকেই চার-ছয় বছরের শিশু। সর্বোপরি নথিভুক্ত ধর্ষণকাণ্ডগুলির ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা হিংস্রতার শিকার ওই নারীর আত্মীয়, স্বজন, নিকট প্রতিবেশী বা পূর্বপরিচিত। আর এখানেই সামাজিক ভরসা ও বিশ্বাসের সনাতন, সযত্নলালিত ধারণাগুলো ভেঙে পড়ার প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। দেহরক্ষীর হাতে নিহত হওয়ার মধ্যে যেমন বিশ্বাসহানি রয়েছে, তেমনই বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপার আছে আত্মজনের হাতে যৌননিগ্রহের ঘটনায়ও। যাকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত, তাকেই হত্যা করা যেমন কৃতঘ্ন বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়তা কিংবা পূর্বপরিচয়ের সূত্রে অর্জিত বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করাও সমান নারকীয়তা। শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণের পরিণতিই এক ও অভিন্ন হলেও।

এই ধরনের ধর্ষণকে ইদানীং ‘পারিবারিক নির্যাতনের’ পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। পরিবারের ভেতরে পুরুষ আত্মীয় ও গুরুজনদের দ্বারা বা পরিবারের বাইরে নিকট প্রতিবেশীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের দুর্গতির কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না, পুলিশের কাছে অভিযোগ করা তো দূরের কথা। কারণ পরিবারই সেই নির্যাতন-নিগ্রহ-লাঞ্ছনার কথা চেপে যায়, লাঞ্ছিতা নারীকে পরিবারের সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে, অনেক সময় তাঁদের দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়, কখনও এমনকী আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দেওয়া হয়। তাতে পরিবারের ‘মর্যাদা’ অক্ষত থাকে, ধর্ষক পুরুষ আত্মীয়ও নিষ্কলঙ্ক থেকে যায়। আর এখানেই ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে পিতৃতন্ত্রের লীলা, নারীর প্রতি বৈষম্যের অনুশীলন। পরিবারের গণ্ডির মধ্যে শুরু হওয়া এই অনুশীলনই বৃহত্তর সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে।

যে দেশে পৌরুষ মানে, নারীর উপরে সম্পত্তির মত অবাধে অধিকার জারি করা, যেখানে প্রতি পদে নারীরা ঘরে-বাইরে হাজার অলিখিত বাধার সম্মুখীন, সেই দেশের নারীদের সুরক্ষা প্রদানের দাবি—অনেকটাই যেন বেমানান!

ধর্ষণ একটি নারীর সত্তার উপরে আক্রমণ, তাকে নিজের অধীনে রাখার জন্যে পুরুষতন্ত্রের একটি অন্যতম হাতিয়ার। দুঃখের কথা আমাদের মতো দেশে এখনও ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের কারণ হিসেবে নারীকেই দায়ী করার মনোবৃত্তি এখনও প্রবল। যশোধরা রায়চৌধুরী একটি কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়েছে—‘হে ধর্ষিতা, তুমি জান, শরীর কোথায় শেষ হয়/কোথা থেকে শুরু হয় অদ্ভুত, দ্বিতীয় অপমান…’!ভারত-ধর্ষণের শিকার শিশু

আমাদের সংবিধান নারীর জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারকে স্বীকার করে নির্যাতন, হিংসা ও আক্রমণমুক্ত জীবনে নারীর অধিকার জন্মগত। ভারতীয় দণ্ডসংহিতা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসাকে দণ্ডনীয় বলে চিহ্নিত করেছে। মূল অভিযুক্ত যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য, নারীর প্রতি হিংসাকে যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করেন নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করে অথবা কতর্ব্যের সীমা লঙ্ঘন করে তাদেরও প্রাপ্য অপরাধীর শাস্তি ও জনমানস থেকে নির্বাসন। এটাই হোক এবারের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের প্রধান দাবি।

দুই.
মানুষের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাগজটুকরো হলো: টাকা। সেই টাকার উপর কেবল বঙ্গবন্ধুর মুখের ছবি দেখে আমরা অভ্যস্ত। অধিকাংশ রাষ্ট্রেই টাকার উপর গুরুত্বপূর্ণ পুরুষের চিত্র মুদ্রিত। আমেরিকা ঠিক করেছে, ২০২০ সালে, একটি নূতন ১০ ডলার মূল্যের নোট বাজারে ছাড়বে, যার উপর মুদ্রিত থাকবে এক নারীর মুখ। ওই সালে, মার্কিন সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর একশত বৎসর পূর্ণ হবে, যে সংশোধনীর বলে, ওই দেশে নারীর ভোটাধিকার কায়েম হয়েছিল। কার মুখ ওই নোটে থাকবে, তা ঠিক করবার ভার মার্কিন কর্তৃপক্ষ সাধারণ নাগরিকদেরই দিয়েছে। একটি ওয়েবসাইটে ও টুইটারে তাঁরা পরামর্শ দিবেন। কয়েকটি দেশে ইতিপূর্বেই নোটের উপর নারীর মুখ শোভা পেয়েছে। ইংল্যান্ড ১৯৬০ সাল থেকে সকল নোটেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি ব্যবহার করে। মেক্সিকোর ৫০০ পেসোর নোটে এক পৃষ্ঠে দিয়েগো রিভিয়েরা ও অন্য পৃষ্ঠে ফ্রিডা কাহ্‌লোর চিত্র ব্যবহৃত, এই চিত্রকর-দম্পতির দুই জনেই ছিলেন নিজ প্রতিভার দৌলতে প্রবল সমাদৃত। আর্জেন্টিনা সম্প্রতি ১০০ পেসোর নোটে ইভা পেরন-এর মুখ ব্যবহার করেছে, তা কেবল এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-ই ছিলেন না, আর্জেন্টিনায় তাঁর স্থান প্রায় লোকগাথার নায়িকার মতো। সিরিয়া ৫০০ পাউন্ডের নোটে রেখেছে রানি জেনোবিয়ার ছবি, যিনি রোমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের ১০ ডলার মূল্যের নোটে কেট শেপার্ডের ছবি পাওয়া যাবে, যিনি নারীর ভোটাধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন ও ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডই যে বিশ্বে প্রথম রাষ্ট্র হিসাবে পুরুষ ও নারীর সমান ভোটাধিকার প্রদান করে, সেই বৈপ্লবিক ঘটনার প্রধান স্থপতি তিনিই। ফিলিপিন্‌স, তুরস্ক, সুইডেনেও নারীর মুখ নোটে পাওয়া যাবে। অস্ট্রেলিয়া এই মুহূর্তে তাদের সব নোটে, হয় সামনে নয় অন্য দিকে, কোনও বিখ্যাত নারীর চিত্র ব্যবহার করে থাকে।

বাস্তব যাই হোক না কেন, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবহারের প্রতি অনীহা ও নারীকে মর্যাদা জানাবার আগ্রহ অন্তত রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রবণতায় প্রবল ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। নারীকে সম্মান জানাবার জন্য দিবস পালিত হচ্ছে, নারী ঋণ নিয়ে তা কম সুদে দেওয়ার জন্য ব্যাংক অগ্রসর হচ্ছে, নারীকে সুরক্ষা দিতে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। নারীকে সম্মান দিয়ে কথা না বললে তার জন্যও বিপদ নেমে আসছে। সম্প্রতি এক নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারে কর্মরত নারীদের সম্পর্কে অমর্যাদাসূচক মন্তব্য করেছিলেন বলে তাঁকে তৎক্ষণাৎ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নারী-অধিকার নিয়ে সবাই ভাবিত থাকবার এই কালে, নোটের উপর নারীর মুখ মুদ্রিত করা এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কি উদ্যোগটি নিতে পারেন না?

বেগম রোকেয়াকে কী আমরা এ জন্য বেছে নিতে পারি না? আগামী ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস। এই দিবসকে ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন একটি ঘোষণা দিতেই পারেন!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)