হুমায়ূন আহমেদ যখন সিনেমা বানাতে আসেন, সাহিত্যিক হিসাবে তিনি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। নাটকের চিত্রনাট্য লিখে সে খ্যাতি আরও বিস্তৃত হয়েছে। ইতোমধ্যে একটা চিত্রনাট্য থেকে হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। লিখেই তিনি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন তিনি কেন নির্মাণের মত পরিশ্রমের মহাযজ্ঞে নিজেকে জড়াতে গেলেন? এইসব প্রশ্নের একটা জবাব কিংবা নিতান্ত তাঁর সিনেমা বানানোর গল্পগুলো নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ছবি বানানোর গল্প’।
জনপ্রিয় হুমায়ূনের খুব সম্ভবত কম জনপ্রিয় এই বই। তিনি মূলত ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে লিখেছেন । বইটার শুরু আসলে তাঁর স্বভাবসুলভ উইট দিয়েই। তাঁর প্রথম সিনেমা দেখার গল্প, যেখানে তিনি তাঁর মামার সাথে হলে যান, ‘বহুত দিন হোয়ে’ নামে সিনেমা দেখেন। সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের সময় তাঁর মামাকে বলতে হয়, ‘পিসাব করব, মামাও বলেন করে দে…’ এর পর ইন্টারমিডিয়েট পড়তে ঢাকা যাওয়া, সেখানে স্বাধীনতার প্র্যাকটিস করতে গিয়ে দেদার যা ইচ্ছা তা সিনেমা দেখা। যার মধ্যে প্রথম দিশা হয়ে দেখা দেন তাঁদের শিক্ষক সুলতানা ম্যাডাম। ‘রোমান হলিডে’ দেখে মন খারাপ শিক্ষকের। ছাত্রদের দেখতে বলেন। হুমায়ূন তা দেখেন আর তাঁর ভাষ্যে, এটাই তাঁর প্রথম ‘ভালো’ ছবি দেখা।
হুমায়ূন আহমেদ এই বইয়ে তাঁর মাথায় সিনেমার পোকা ঢোকানোর দায়টা চাপিয়েছেন আনিস সাবেতের ঘাড়ে। যিনি সারা জীবন স্বপ্ন দেখতেন ফুললেন্থ সিনেমা বানানোর। কিন্তু তিনি তা করে মরতে পারেন নি। ক্যানসার আগেই তাঁকে পরাজিত করেছে। মৃত্যুর কিছু আগেও যিনি হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করে বলছেন, তোমাকে বিরক্ত করছি, মৃত্যর আগে প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছা করে। সাবেত মারা গেলেন, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন হুমায়ূনের ভেতর ঢুকে গেলো, “মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাদের স্বপ্ন মরে না। সাবেত ভাই মারা গেলেন কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে রইল। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেলো আমার মধ্যে।” হুমায়ূন সেই স্বপ্নের টানেই সিনেমা বানাতে লাগলেন একের পর এক, যার প্রথমটা ‘আগুনের পরশমণি’।
হুমায়ূন চিত্রনাট্য লিখে বসে আছেন। টাকা নাই ছবি বানানোর মত। সবমিলে তাঁর কাছে আছে দুইলাখ টাকা। টাকা যোগাতে তিনি দ্বারস্ত হলেন আসাদুজ্জামান নূরের। ‘টাকা কোনো ব্যাপার না’ বলে অভয় দিলেন নূর। কিন্তু টাকা মিলে না। এর মধ্যেই একদিন আসাদুজ্জামান নূর সুখবর দিলেন। সানোয়ারা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যন নুরুল ইসলাম বিএসসি সাহেব টাকা দিবেন। আলোচনার জন্য ডেকেছেন। তবে এখানে একটা শর্ত আছে, একটা বইয়ের আলোচনায় সভাপতি হতে হবে। রাজি হলেন, যদিও এসব অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন তিনি। গিয়ে এক মস্ত কালো কৌতুকের সম্মুখে পড়তে হল, আলোচকের কথার সারবস্তু হলো – বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের সৃষ্টি হলো, বেকনের পর এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিওয়ালা লেখক আর আসছেন কিনা জানেন না…! আলোচনার পর প্রস্তাব আরো মজা করে হুমায়ূন বর্ণনা করছেন, বিএসসি সাহেব চান তাঁর একটা গল্প থেকে সিনেমা হোক। অসম্মানিত অপমানিত হয়ে তিনি ফিরে আসেন।
এইদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণে সেই বছর সরকারি অনুদানের জন্যও আবেদন করেন হুমায়ূন আহমেদ। তখন তথ্য মন্ত্রী নাজমুল হুদা। হুমায়ুন আহমেদ যান তাঁর কাছে। তিনি বলেন চিত্রনাট্য জমা দিতে। নাজমুল হুদার একক প্রচেষ্টায় সেবছর তিনি অনুদান পান। বোর্ডের সবাই যখন বলছিল তাঁকে অনুদান দেয়াটা অপচয় হবে তখন হুদা বলেন, “…দেখুন সরকারি অর্থের অনেক অপচয়ইতো হয়। হাজার চেষ্টা করেও আমরা অপচয় বন্ধ করতে পারি না। না হয় হলো আর একটু অপচয়। ছবির জগতে আপনারা যারা আছেন তাঁদের তো অনেক অনুদানই দেয়া হয়েছে তেমন কিছু কি আপনারা দিতে পেরেছেন? এমনও হয়েছে, টাকা দেয়া হয়েছে কিন্তু ছবি তৈরি হয় নি। হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে আমরা না হয় একটা এক্সপেরিমেন্টই করলাম।দেখা যাক। তিনি যদি ফেল করেন আপনারাতো আছেনই। আপনারা ভালো ছবি বানাবেন।”
‘আগুনের পরশমণি’ বানানো শেষ হবার সময় নাজমুল হুদা আর মন্ত্রী নন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ শুধু তাঁর জন্য একটা প্রদর্শনী করেন এফডিসিতে।
হুমায়ূন আহমেদ প্রথম সিনেমা বানাতে গিয়ে পেয়েছেন মজার সব অভিজ্ঞতা। বদি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। বদিউল আলম টগবগে যুবক আর নূরের ৫০ এর আশপাশে তখন। কিন্তু দুর্দান্ত মানিয়ে গেলো তাঁকে। নূর সম্পর্কে হুমায়ূন বলেন, “নূরকে আমার সবসময় মনে হয় ডাস্টিন হফম্যানের চেয়েও বড় অভিনেতা।” বিপাশা করলেন সেরাটা। হুমায়ূন আহমেদের প্রত্যাশা ডলি জহুর আর আবুল হায়াত পূরণ করতে পারেননি। হুমায়ূন বলছেন, তিনিই আদায় করতে পারেননি। ছোট চরিত্রে দিলারা জামান মাত করে দিলেন। এইসব বলছেন হুমায়ূন তাঁর কুশিলবদের নিয়ে। একটা বিরক্তির কথাও খুব মজা করে তিনি জানাচ্ছেন, সালেহ আহমেদকে তিনি একমাস দাড়ি কাটতে বারণ করেছিলেন অভিনয়ের জন্য, শুটিংয়ের দিন তিনি হাজির হলেন ক্লিন শেভড হয়ে! এইটা নিয়ে তাঁর ছিল বিরক্তি। আলাদা করে অভিনয়ের প্রসংসা করেন ওয়ালিউল ইসলাম ভূঁইয়ার। সাবেক এই নৌ কর্মকর্তা অভিনয় করেন পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসারের ভূমিকায়। সত্য সাহা যুক্ত হয়েছিলেন যেচে ফোন করে। আর এই ছবির জন্যই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান প্রথমবারের মত। তাঁর আফসোস ঘুচে। এই ছবিতে কাজ করেছেন মাসুক হেলাল, ধ্রুব এষের মত আর্টিস্ট।
ছবি বানাতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন মজার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। সেগুলোর একটা হচ্ছে পরিচালক সমিতির পরীক্ষা! হুমায়ূন আহমেদকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে কাজ করার জন্য চলচ্চিত্র সমিতিতে। চাষী নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০ জনের মত এফডিসির নির্মাতা তাঁর পরীক্ষা নেন। বিচিত্র প্রশ্নে। পরীক্ষকরা তাঁকে যে প্রশ্ন করে তাঁর প্রথমটা ছিল, ‘হুমায়ূন কবির সাহেব, ছবির পরিচালনা বলতে আপনি কী বুঝেন?” তিনি উত্তর করলেন, “…কিছু মনে করবেন না, আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ।” আবার একই প্রশ্ন, হুমায়ুনের জবাব, “ছবি পরিচালকের মূল কাজ হচ্ছে ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মত, একটা সাদা টুপি পরে হাসি মুখে চেয়ারে বসে নায়িকাদের সাথে ফষ্টি নষ্টি করা।”
এমন উত্তরে মুখ কালো লোকেদের আবার বলে দেন যে তিনি রসিকতা করেছেন। পরে বলেন, “আইজেনস্টাইনের ছবি যদি স্টিম ইনজিন হয় তাহলে পরিচালক হচ্ছেন সেই স্টিম ইনজিনের স্টিম।” বলা বাহুল্য আইজেনস্টাইনের এই মত আসলে বানানো ভয়াবহ রসিকতা। যাক, এসবের পরেও তিনি সেই পরীক্ষায় কোনোমতে উতরে যান, যদিও তাতে সরাসরি পরিচালক হিসাবে সদস্য পদ পাননি, সহকারি সদস্য পদ পেয়েছিলেন!
‘আগুনের পরশমণি’তে একটা দৃশ্য নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের আফসোস ছিল। তিন জন উলঙ্গ মানুষকে নিয়ে পৈচাশিক আনন্দ করছিল পাকিস্তানি সেনারা, রাস্তায় কাপড় খুলে। সেখানে বদিরা এসে পাকিস্তানি টহলদারদের হত্যা করে। সেই দৃশ্যে এই পরাজিত কুণ্ঠিত মানুষের এক নিমিশেই বিজয়ীতে পরিনত হওয়ার পর এই উলঙ্গ মানুষের উল্লাস তিনি ক্যামেরায় ধরতে পারেননি বলে তাঁর আফসোস ছিল। ছবিটা সেন্সরে জমা দেয়ার পর যে আপত্তি ছিল, তাও ব্যাক থেকে এই দাঁড়িয়ে থাকা উলঙ্গ মানুষ আর শেখ মুজিবের ভাষণ নিয়ে। হুমায়ূন কোনটাতেই কম্প্রোমাইজ করেননি।
এই ছবিতে হুমায়ূন আহমেদ নানান আমলাতান্ত্রিক জটিলতাতে পড়েছিলেন। খালি পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতির জন্য তাঁকে বেশ কয়েকদিন ঘুরতে হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাও কাজ হয় নি। পরে সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খান খুব আন্তরিক সহায়তা প্রদান করেন। ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের একজন মেজর ও ২০০ সেনা সরাসরি কাজে যুক্ত হন, যুদ্ধের অংশ শুট করতে। ব্যবহার করতে দেন স্টেনগান, মিলিটারি কনভয় এমন কি ট্যাঙ্ক! ফাইট দৃশ্য করায় সাহায়তা করেন ইমামুজ্জামান বীর বিক্রম। তাছারা পরবর্তিতে আবার প্রয়োজন হলে পরের সেনা প্রধান লে. জে. আবু সালেহ মুহাম্মদ নাসিম বীর উত্তমও সাহায্যের হাত বাড়ান। বাংলাদেশের সিনেমাতে প্রথম সেনা সহায়তায় যুদ্ধের দৃশ্য করানোর কাজটা হয় হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরেই।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবিতেই মানুষকে একটা ধাক্কা দেন। তিনি আওয়াজ দেন, তিনি আর সবার মত না। এসেই জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রায় সব পুরস্কার জিতেন। সত্য সাহা সারাজীবন কাজ করে যা পাননি তা পান হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে কাজ করে। তিনি বিএনপির সময়ে বানানো ছবিতে প্রথম দিকের দৃশ্যেই শোনান শেখ মুজিবের ভাষণের অংশ, সেই ছবির প্রিমিয়ার শোতে উপস্থিত করান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে!
হুমায়ূন আহমেদের মতই বৈচিত্র্য আর বর্ণাঢ্য তাঁর প্রথম ছবি। এমনকি বাংলাদেশের সিনেমাতেও তা আলাদা। আর তাঁর সিনেমার ভাষা যেন তাঁর গদ্যের মতই সাধারণ, অতি সাধারণ কিন্তু অনন্য, তাঁর বইয়ানেই শুনি ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমা নিয়ে তাঁর প্রত্যাশা- “কোন তত্ত্ব কথা না,- আমি যা করবো তা হচ্ছে ঘটনাগুলো অতি সরল ভঙ্গিতে ভিজ্যুয়ালি ট্রান্সফরম করবো।” তিনি তাই করেছেন আর ভিজ্যুয়াল ফরমেও তিনি হাত রেখেছেন মানুষের হৃদয়ে।