এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটু ভিন্ন আমেজ ও উৎসাহ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন জরিপ ও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার প্রতিবেদন প্রকাশের হিড়িক লেগে গেছে। নির্বাচনের উত্তেজনা সারা বিশ্বের মতো সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে গড়িয়ে বাংলাদেশেও এসেছে। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক-টুইটারে ডোনাল্ড ট্রাম্প না হিলারি ক্লিনটন, এই হিসাব আর যুক্তিতর্ক ভাসছে।
মার্কিন শুমারি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী নাগরিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ, ইমিগ্রেশনের স্ট্যাটাসহীনসহ ধরলে সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এবারের এই আলোচিত নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন ওইসব বাংলাদেশী মার্কিন নাগরিক?
পরিস্থিতি বুঝতে চ্যানেল আই অনলাইন কথা বলেছে কয়েকজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে। তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জানিয়েছেন নির্বাচনের আগে-পরের হিসাব।
অরল্যান্ডো ফ্লোরিডার বাসিন্দা ডা. রুমি আহমেদ খান তার এলাকার নির্বাচনী পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট জানিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকেবলেন, আমি যে এলাকায় থাকি সে এলাকার মানুষগুলো, আমার কর্মক্ষেত্রের মানুষজন, আমার রোগী এবং প্রতিবেশীরা বেশিরভাগই, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। আমার এক সার্জন বন্ধু একবার আমার হিজাব পরা মায়ের অস্ত্রোপচার করেছিলেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলাম। সেদিন দেখলাম তিনি ট্রাম্পের র্যালিতে অংশ নিয়েছেন। সঙ্গে ‘ট্রাম্পের পক্ষে নারী’ লেখা বোর্ড নিয়ে ছিলেন তার স্ত্রী। নরম মনের সেই নারী আমারও একজন বন্ধু।
ঠিক কী ধরণের মার্কিন নাগরিকরা ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করছে এবং ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, তা জানিয়ে ডা. রুমি বলেন, গ্রামের, মফস্বলের এবং শহরের সব সাদা মানুষই ট্রাম্পের পক্ষে। যে শ্বেতাঙ্গরা তাকে ভোট দিচ্ছে না, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ইউনিয়নের সদস্য। তারা তাদের ডেমোক্র্যাট ইউনিয়ন লিডারদের মানসিক নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে তরুণ এবং বিশেষ করে নারী শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে হয়তো ট্রাম্প বেশি ভোট পাবেন না।
তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় না বর্ণবাদ এখানে নির্বাচনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। হ্যাঁ, বর্ণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিভিন্ন গোষ্ঠি বিরোধী ও নারীর অবমাননাকর বক্তব্যের পরও কেনো শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিকরা ট্রাম্পকে ভোট করবেন, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক, এশীয়সহ ভিন্ন ভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে আমার ধারণা, অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় শ্বেতাঙ্গরা সবচেয়ে বেশি বিবেচনাবোধ সম্পন্ন, সহনশীল, মানবিক এবং যত্নশীল। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলসহ কিছু ক্ষেত্রে লোকজন সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সমরূপতার পাশাপাশি তাদের চিরাচরিত জীবনপ্রণালী হারানোর ভয়ে আছে। মিনেসোটার সেইন্ট ক্লাউডে হঠাৎ করেই শ্বেতাঙ্গদের সবগুলো শহরের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সোমালীয় হয়ে গেছে। তারা সোমালীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফলে যখন ১৫ জন বোরকা পরা সোমালীয় নারী ১৫/২০টা স্ট্রোলার (শিশুবাহী গাড়ি) নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হন, তখন অনেকে মনে করেন, সোমালীয়রা হয়তো তার এলাকায় কোনো ধরণের ধর্মীয় প্যারেড করছে। এতে অনেকেই ভয় পেয়ে সবার মাঝে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। ট্রাম্প নীতি বা ‘ট্রাম্পিজম’ এমন পরিস্থিতিতেই বেড়ে ওঠে।
কর্মসংস্থান ও শিক্ষার খাতগুলোতে অভিবাসী মার্কিন নাগরিকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়াতে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারনীতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ভারতীয়সহ অন্যান্য এশীয় পেশাদারদের সংখ্যা বাড়ছে। তারা বেশি পদোন্নতি পাচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বড় বাড়িতে থাকতে পারছে। প্রত্যেক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী প্রায় দু’ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ মাথায় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে। বিদেশে প্রশিক্ষণ পাওয়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, যারা ইংরেজি বলতে পর্যন্ত পারেন না, তারা এসে ভালো ভালো চাকরিগুলো দখল করে নিচ্ছেন। পেশাগত অনিশ্চয়তা বা ঈর্ষার মতো বিষয়গুলোও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কাজ করছে বলে জানান ডা. রুমি।
এছাড়া প্রান্তিক ভোটারদের ট্রাম্পকে ভোট দিতে আগ্রহী হওয়ার পেছনে হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ছড়ানো নেতিবাচক প্রোপাগান্ডাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ওই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডাক্তার বলেন, একজন সাধারণ শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক অন্য জাতির মানুষদের তুলনায় কম সন্দেহ করে। তাই তারা টিভি বা রেডিওতে যা শোনে অথবা ‘ইন্টারনেটে’ যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করে। শহুরে সাদাদের তুলনায় গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি। এই মানুষগুলো হিলারির বিরুদ্ধে শোনা সব কথাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। কট্টর ডেমোক্র্যাট ছাড়া প্রত্যেক শ্বেতাঙ্গই এখন হিলারির ঘৃণ্য অপরাধের অভিযোগগুলো সত্যি বলে মেনে নিয়েছে।
তবে নির্বাচনে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার আরেকটি দিক উল্লেখ করে ডা. রুমি বলেন, ‘থ্রিএম’ -মেক্সিকান, মুসলিম এবং ম্যাডোনা (নারী) ট্রাম্পিজমের প্রসারে আগের দু’টি কারণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একজন সাধারণ মার্কিন নাগরিক আরেকজন মেক্সিকান, মুসলিম, আরব, ভারতীয় বা এশীয় মার্কিন নাগরিকের মাঝে পার্থক্য ধরতে পারে না। না চেহারা দেখে, না নাম থেকে। মেক্সিকান ধর্ষক ও মাদক ব্যবসায়ী আর ইসলামের নামধারী জঙ্গিদের ভয়ে এখন তারা ভিন্ন চেহারার সবাইকেই ভয় পায়।
এছাড়া প্রবীণ মার্কিন নাগরিকদের অনেকের মাঝেই একজন ‘ম্যাডোনা’ তথা নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে না পারাটাও ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করছে বলে জানান অরল্যান্ডোবাসী এই ডাক্তার।
ডা. রুমি এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোটা দাগে ট্রাম্পের জয়লাভ করার অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ দেখতে পাচ্ছেন।
টেক্সাসের মারফি এলাকার বাসিন্দা ব্যাংকার ও কলাম লেখক শাফকাত রাব্বী নির্বাচন পরিস্থিতি সর্ম্পকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবে নাকি হিলারি হবে তার চাইতেও জরুরী বিষয় হলো, সিনেট এবং কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কী পাবে না। এর কারণ হচ্ছে মার্কিন সিস্টেমে, প্রেসিডেন্টের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা মূলত পররাষ্ট্র নীতি, সমরনীতি, আর জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ দিতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোন কিছুই করতে পারেন না সিনেট ও কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া।
হিলারি বা ট্রাম্পের মধ্যে কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কী ধরণের প্রভাব অভিবাসীদের উপরে পড়বে, এ প্রশ্নের জবাবে রাব্বী ট্রাম্প সর্ম্পকে বলেন, ক্লিনটন এবং ট্রাম্প এই দুই-ব্যক্তির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো এদের স্টাইল এবং মানসিকতা। ট্রাম্পকে শুরুতে একজন ঝানু ব্যবসায়ী ভাবতাম। তবে তার ক্যাম্পেইন স্টাইল দেখে আমার সে ধারণা পালটে গেছে। ট্রাম্প অনেক বেশী আবেগী এবং তিনি তার ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। একারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হলে কী করবেন আর কী করবেন না, তা বলা খুব মুশকিল। তিনি খেয়ালের বশে ইমিগ্র্যান্টদের জন্যে অনেক ভালো কিছুও করে ফেলতে পারেন, আবার অনেক খারাপ কিছুও করতে পারেন, যেমনটা তিনি এই মুহূর্তে গরীব সাদা জনগোষ্ঠির ভোট জেতার জন্যে বলছেন।
একই বিষয়ে তিনি হিলারি সম্পর্কে বলেন, হিলারি একজন হিসেবী রাজনীতিবিদ। তিনি আবেগী নন, অনেক বেশী আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ। হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে ওয়ার্ল্ড অর্ডার স্থাপন করেছে, তাতে আমরা আবার ফিরে যাবো পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। আর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হিলারি হবেন ওবামা প্রসাশনের একটা চলমান ধারা।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে অভিবাসীদের বের করে দেবেন, এমন ঘোষণা এখনও গ্রিনকার্ড পায়নি এমন বাংলাদেশীদের মধ্যে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে ওই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যাংকার জানান, বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্টরা মূলত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে থাকে, যেগুলোর সব ক’টি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসনের অধীনে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও সেই সব রাজ্য প্রশাসনের পরিবর্তন হবে না। তবে এটা ঠিক, ট্রাম্পের অধীনে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পের অপছন্দের তালিকাটা অনেক বেশি বড়। সেখানে কালোরা আছে, হিস্পানিকরা আছে, সাদা লিবারেলরা আছে, শিক্ষিত মার্কিন নাগরিকরা আছে, পরিবেশবাদীরা আছে, গণমাধ্যম আছে, নারী আছে। এতো বড় একটা বিরোধী শিবির নিয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে পরে হিমশিম খাবেন। বাংলাদেশী কমিউনিটির ওপরে ট্রাম্পের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা পড়লেও, তা পড়বে ওপরে উল্লেখিত সব কয়টি গ্রুপের পাশাপাশি। আমরা বাংলাদেশীরা একা আউট হবো না।
নিউইয়র্কের সানিসাইড এলাকার বাসিন্দা ফিনান্সিয়াল ম্যানেজম্যান্ট এক্সিকিউটিভ তরুণ দাস গুপ্তা এবারই প্রথম ভোট দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি মার্কিন নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম ভোট দেওয়ার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কিছুটা হতাশা ভরা কন্ঠে তরুণ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর কৌতুহল সবসময়ই ছিল, এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। প্রথম ভোট হিসেবে আমারও আগ্রহ আছে, কিন্তু নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে ততোই ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি।
‘যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচনী সংস্কৃতি এই বিষয়গুলো পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণ হিসাবে দেখা হতো। কিন্তু আমি নিশ্চিত ২০১৬ সালের নির্বাচনের যে চিত্র বিশ্ববাসী দেখছে তাতে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে।’
২০১২ সালের নির্বাচন আর এবারের নির্বাচন দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টি ব্যাখা করে তরুণ বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চলার সময় প্রার্থীদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতো, বড় বড় গাল ভরা বুলি না আউড়ে জনগণের প্রয়োজনীয় বিষয় যেমন, অর্থনীতি, অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি, স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা হতো, প্রার্থীরা জনগণের এই প্রয়োজনীয় ইস্যু নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরতেন, হেরে গেলে আন্তরিকতার সাথে মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে শুভেচ্ছা জানাতেন, এগুলোই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের চিত্র। কিন্তু এইবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন। প্রার্থীরা জনগণের প্রয়োজনীয় ইস্যুগুলো নিয়ে যতো না আলোচনা করেছে, তার চেয়ে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি করেছে। হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প, দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী সংস্কৃতিকে নষ্ট করেছেন।
আবারও হতাশাভরা কন্ঠে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণ বলেন, এবারের নির্বাচনের প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই পর্বে সবচেয়ে বড় হতাশাজনক বিষয় ছিল ব্যবসায়ী ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প এর রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন পাওয়া। বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাই হলো যুক্তরাষ্ট্রেরর মূল সৌন্দর্য, যেখানে পৃথিবীর সব দেশের, সব ভাষার, সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের সমান অধিকার আছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে আসা মানুষ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র, এখানে সবাই অভিবাসী। কেউ হয়ত একশো বছর আগে এসেছে, কেউ হয়ত দশ বছর আগে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সেই বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থার সৌন্দর্যে আঘাত করেছেন। তিনি অভিবাসী এবং মুসলিমদের নিয়ে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেছেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে যে অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, বিচার ব্যবস্থা, অভিবাসী, মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে তার যে ভাবনা, এগুলো তাকে বিতর্কিত এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার এর কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এমনকি রিপাবলিকানদের একটা অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্প এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
প্রায় একই ধরণের মন্তব্য তার হিলারি ক্লিনটনকে নিয়েও, হিলারি বিষয়ে তিনি বলেন, হিলারি ক্লিনটন হলেন ব্যক্তিগতভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তার ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য রাষ্ট্রপ্রদত্ত প্রভাব এবং দলীয় প্রভাব বিস্তারের বিষয়টা মানুষের মনে অনেকটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইয়ে প্রভাব ফেলে বার্নি স্যান্ডার্সকে হারিয়ে দেওয়া, ইমেইল কেলেংকারি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে বিশেষ আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো তাকেও বিতর্কিত করেছে। তবে তার অভিবাসন ভাবনাকে অভিবাসীরা স্বাগত জানিয়েছে।
তরুণের দৃষ্টিতে কে এবারের প্রেসিডেন্ট হচ্ছে, তা তিনি পরিস্কারভাবে মন্তব্য না করে জানালেন, এই দুই প্রার্থীর যেই নির্বাচিত হোক না কেনো, ২০১৬ এর নির্বাচনের মধ্যেদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একজন অগ্রহণযোগ্য ও অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে পেতে পাচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক রউফ এবারের মার্কিন নির্বাচন বিষয়ে হিলারি সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য দিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তবে তার কথাতে যতোটা না হিলারির প্রশংসা আর ইতিবাচক দিক ছিলো, তার চেয়ে বেশী ছিলো ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে কী কী সমস্যা হতে পারে তার ব্যাখ্যা।
পেশায় সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার ও ফটোগ্রাফার ইশতিয়াক হিলারির বিষয়ে বলেন, নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে জিতলে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্তমানে যেমন আছে তেমনটাই থাকবে।
ট্রাম্প জয়ী হলে কী ধরণের সমস্যা হতে পারে আর তা সামাল দিতে মার্কিন নিয়ম-আইনের কথা উল্লেখ করে ইশতিয়াক বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলে বাংলাদেশী কমিউনিটির ওপর আলাদা ভাবে তেমন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। মোটা দাগে বললে ‘অভিবাসী’দের ওপরও তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রকম নিয়ন্ত্রণ আছে, কেউ চাইলেই স্বৈরতান্ত্রিক কিছু করে ফেলতে পারবে না। কেউ কোনো প্রকারের অপরাধের শিকার হলে, সেই ব্যাপারে পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থা কোনো ছাড় দেবে না।
মার্কিন আইন-আদালত বিষয়ে ইশতিয়াকের আস্থা থাকলেও সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ট্রাম্প জয়লাভ করলে যুক্তরাষ্ট্রেরর সমাজব্যবস্থায় অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি আইনী সমতা বজায় থাকলেও সমাজে সবার একই সম্মান নাও থাকতে পারে। এই নির্বাচনে মানুষের মধ্যের বিদ্বেষ, জাত্যাভিমান ও বর্ণবাদ অনেক বেশি উস্কানি পেয়েছে। আগামী কিছু বছরে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে যাওয়ার ভয় আছে।
এবারের মার্কিন নির্বাচনের পরে এই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশের মতো নির্বাচন শেষে সংহিসতা আর নাশকতার আশঙ্কা করছেন ।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের ঠিক পরপর সহিংসতা নিয়ে অনেকে যৌক্তিক কারণেই ভীত। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ে আছে মেক্সিকান, হিস্পানিক ও আরব জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশীদেরও কিছু ভয় আছে, যেমনটা আমরা কিছুদিন আগে নিউইয়র্কসহ অন্যান্য জায়গায় ঘটতে দেখেছি। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই এখন অভিবাসীদের বিপক্ষে জনমত গড়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সেই ধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই হবে বলে ধারণা।
মার্কিন নির্বাচন নিয়ে নানা আশা-হতাশা আর উৎকন্ঠা থাকলেও নির্বাচন প্রিয় জনগোষ্ঠি হিসেবে বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে এক নিরব উৎসবের আমেজ কাজ করছে বলে প্রায় সবাই চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান। অনেক বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবক স্ব স্ব পছন্দের দল-প্রার্থীর পোস্টার, ব্যাজ, রিস্টব্যান্ড নিয়ে প্রচারণা কাজে ব্যস্ত। সেইসাথে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের আগাম ভোট দিতে দেখা গেছে বলেও জানান তারা। তারা অনেকটা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন, ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা দেখার জন্য।