রাজনীতিতে সমমনা দলগুলো নিয়ে জোট হতেই পারে। বিশেষ কোনো আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নে অথবা ‘কমন-ইন্টারেস্ট’-এর ভিত্তিতে সমমনাদের নিয়ে জোট গঠন আমাদের দেশে মোটামুটি স্বীকৃত রীতি। কিন্তু কোনো রকম নীতি-আদর্শের ধার না ধরে এমনকি রাজনৈতিক আইডেনটিটি বিসর্জন দিয়ে জোট গঠন করাটা প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈকি! যেমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে আমাদের চলতি রাজনীতিতে বহুল আলোচিত জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির সভাপতি কাদের সিদ্দিকী ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না তাদের নিজস্ব নির্বাচনি প্রতীক বিসর্জন দিয়ে এবার ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলো একক প্রতীক হিসেবে বিএনপির ধানের শীষকে বেছে নেওয়ায় ড. কামালের গণফোরামের উদীয়মান সূর্য, জেএসডির তারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা এবার ব্যালট পেপারে নির্বাচনি প্রতীক হিসেবেই আর থাকছে না!
আমাদের দেশের ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো প্রতীক বা মার্কা। ধানের শীষ বিএনপির প্রতীক। আর বিএনপির মূল নেতৃত্ব এখন আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে জেলে রয়েছে। এই দলটি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার পরও বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ২০ দলীয় জোটে জামায়াত এখনও বহাল তবিয়তে। জামায়াত ও বিএনপি বঙ্গবন্ধু এবং তার অবদানকে স্বীকার করে না। অথচ ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেন। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকার সমাবেশে তারা অনেকবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। ধানের শীষ নিয়ে জামায়াত লড়বে, লড়বে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে, লড়বেন ড. কামাল হোসেনও। তারা ধানের শীষে নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন?
আমাদের দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনি প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাতিল হওয়ার পর এই ধানের শীষ এখন জামায়াতেরও আশ্রয়। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, ঘাতক-দালাল-রাজাকারের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন, তাহলে আর রাজনীতিতে আদর্শ থাকল কোথায়? প্রশ্ন হলো রাজনীতিতে ক্ষমতাই কি সব? ন্যূনতম নীতি-আদর্শও যদি অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে দেশবাসী আপনাদের সমর্থন করবে কোন যুক্তিতে?
রাজনীতির নীতিহীনতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের নাম ড. কামাল হোসেন। তিনি যেদিন (১৫ নভেম্বর) ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ৩৭ বছর আগে ঠিক সেই দিনই তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীকের কাছেই পরাজিত হয়েছিলেন। প্রহসনের সেই নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিতের পর ড. কামাল বলেছিলেন, ধানের শীষ প্রতীক হলো প্রতারণা, প্রবঞ্চণার প্রতীক। ধানের শীষ প্রতীক হলো জনগণের ভোটাধিকার হরণের প্রতীক। আজ তিনি নিজেই সেই প্রতারণা, প্রবঞ্চণার প্রতীককে নিজের করে নিয়েছেন! এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কি হতে পারে?
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি কলঙ্কিত নির্বাচন হলো ১৯৮১ এর ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর শুধুমাত্র বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আব্দুর সাত্তারকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করে তাকে প্রার্থী হিসেবে যোগ্য করা হয়। সংবিধান সংশোধনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ড. কামাল। ওই নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী আব্দুর সাত্তারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ড. কামাল হোসেন। ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি, প্রহসনের নির্বাচনের ফলাফলে আব্দুর সাত্তার পান ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। তিনি ভোট পান ১ কোটি ৪২ লাখ, ৩ হাজার ৯৫৮ টি। আর ড. কামাল হোসেনকে দেখানো হয় ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। মাত্র ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার ১১৩ ভোট দেখানো হয় ড. কামালের ব্যালটে। নির্বাচনের ভোট গণনার কিছুক্ষণের মধ্যে এটি যে এক প্রহসনের নির্বাচন তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই হোটেল পূর্বাণীতে ড. কামাল হোসেন একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ধানের শীষ প্রতীক বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে। ধানের শীষ প্রতীক হলো প্রতারণা, প্রবঞ্চনার প্রতীক। ধানের শীষ প্রতীক হলো জনগণের ভোটাধিকার হরণের প্রতীক। এই প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাসে কলঙ্ক রচনা করা হয়েছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস ৩৭ বছর পর আজ সেই একই দিনে সেই ড. কামাল হোসেন সেই প্রতীককেই আঁকড়ে ধরলেন, তার ডুবন্ত রাজনীতির তরী বাঁচানোর জন্য! নিজের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য নীতি বদলে ফেলতে হবে? তাহলে আর মুখে আদর্শের বুলি কেন?
ড. কামাল, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহম্মদ মনসুরসহ ঐক্যফ্রন্টের বেশ কিছু নেতা আছেন, যারা প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের কথা বলেন, সুশাসনের কথা বলেন, মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেন। তারা যদি আদালতের রায়ে খুনি সাব্যস্ত একজনের নেতৃত্ব মেনে নেন, তাহলে তাদের দ্বারা জনগণের কোনো কল্যাণের আশা করা যায় কি? রাজনৈতিক কৌশলের নামে নৈতিক অধঃপতন কীভাবে মেনে নেয়া যায়? যদ্দূর মনে পড়ে, ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণফোরাম আয়োজিত এক মানববন্ধনে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘কেবল বাংলাদেশে নয়, জার্মানি ও আমেরিকার আদালতে কোকোকে বিভিন্ন অপরাধে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচিত এ বিষয়টি বিটিভির মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। আর যদি সরকার তা না করে, তাহলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমিই প্রকাশ করবো। হাওয়া ভবন আবার ফিরে আসুক, আমরা এটা চাই না।’
মানববন্ধনে ড. কামাল আরো বলেছিলেন, ‘অতীত ভুলে গেলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়। হাওয়া ভবনের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এ ভবন থেকে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে ভবিষ্যতে আর সে সুযোগ দেওয়া যাবে না। ’ ড. কামালের এই বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এই বক্তব্যের মাত্র ৬ বছরের মাথায় এসে কামাল হোসেন ঘোষণা করছেন, ঐক্যফ্রন্ট জিতলে তিনি হবেন রাষ্ট্রপতি আর তারেক রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী! ৬ বছর আগে ও পরের ড. কামাল হোসেনকে মেলানো যায়, না চেনা যায়? সেই হাওয়া ভবনের নিয়ন্ত্রক তারেক রহমানকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে দিচ্ছেন! এই তারেক রহমান ভয়ঙ্কর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। তার দলের সঙ্গে ঐক্য করে, ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখতে চাইছেন!
তিনি আসলে দেশে কোন ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন? তিনিই বলেছিলেন, অতীত ভুলে গেলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়। তা হলে তার মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হঠাৎ অতীত ভুলে গেলেন কেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)