ভালো আছেন আমাদের আবুল বাজানদার। রোববার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার হাসপাতাল জীবনের ৩ মাস ১৫ দিন পূর্ণ হয়েছে! আরও কমপক্ষে তিন মাস তার হাসপাতালে থাকা লাগতে পারে।
হাতপায়ে গাছের শেকড় জন্মানো বিরল রোগী আবুলকে যখন আমরা খুলনার পাইকগাছার গ্রাম থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি তখন তার এই দীর্ঘ-জটিল চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। খুলনার সাংবাদিক সুনীল দাসের মাধ্যমে আমি আবুলের সন্ধান পাই। সুনীল দাসের অনুরোধে সিডনিতে বসে আমি আবুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জড়াই তার চিকিৎসা মিশনে।
ঢাকায় আমার একজন প্রিয় স্বজন আছেন ডা. শরফুদ্দিন আহমদ। যখন যার চিকিৎসায় জড়াতে চাই তাকে ফোন করলেই একটা পথ তিনি তৈরি করে ফেলেন! প্রিয় শরফুদ্দিন ভাইকে ফোনে আবুলের বিষয়ে অনুরোধ করলে তিনি তার খুলনার ডাক্তার বন্ধুদের দিয়ে প্রথম আবুলকে দেখার ব্যবস্থা করান।
এরপর ডা. শরফুদ্দিন ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের সমম্বয়কারী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে কথা বললে তিনি তাকে ঢাকায় তার কাছে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন।
আমার ইচ্ছা ছিল প্রিয় সুনীল দাস আবুলকে ঢাকা নিয়ে আসবেন। কিন্তু পেশাগত কাজের ব্যস্ততায় তিনি তার সঙ্গে ঢাকা আসতে পারেননি। আবুলকে ঢাকা আনার জন্যে আমি টাকা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে টাকাও তখন খরচ করা যায়নি। আবুলকে ঢাকা আসার খরচ দেন খুলনার সেই ডাক্তাররা, যারা তাকে প্রথম দেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুসারে সুনীল দাস তাদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আমাদের এক প্রিয় প্রজন্ম নিয়াজ মাহমুদ রনি আবুল পরিবারকে ঢাকায় বাস স্ট্যান্ডে রিসিভ করে চানখাঁরপুল এলাকার একটি হোটেলে তোলেন। পরের দিন সকালে এই রনিই তাকে ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে নিয়ে যান।
সে দিনটি ছিল গত বছরের ৩০ জানুয়ারি। ডা. সামন্ত লাল সেন তাকে দেখেই সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, আজ থেকে আবুলের দায়িত্ব আমাদের। তার চিকিৎসা হবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সম্পূর্ণ খরচে। এরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে একই ঘোষণা দেন। সেই থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের ৫১৫ নাম্বার কেবিনটিই আবুল পরিবারের ঠিকানা। সেখানে তার চিকিৎসার পাশাপাশি তার পরিবারের খাওয়া দাওয়ার যাবতীয় খরচ চলছে সরকারিভাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এর মাঝে তাকে দু’বার দেখতে গেছেন। শেষবার গিয়ে তিনি পরিবারটির হাতে বেশ কিছু টাকাও দিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্র যে চাইলে কিভাবে একজন অসহায় রোগী, তার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে, আবুলের ঘটনা এর সর্বশেষ নজির।
আবুল যেদিন ঢামেকে ভর্তি হন সেদিনই তিনি দেশি-বিদেশি মিডিয়ার নজরে পড়েন। এরপর থেকে পৃথিবীতে যত ভাষার মিডিয়া আছে এর প্রায় সবক’টিতে এর মাঝে আবুলকে নিয়ে খবর-প্রতিবেদন ছাপা-প্রকাশ হয়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে তার নাম হয় বৃক্ষমানব। মিডিয়ার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরে আসেন আবুল। সংস্থাটির আমেরিকার সদর দফতরে এখন আবুলের রোগটিকে নিয়ে গবেষণা চলছে। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তাররা তার চিকিৎসা নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সেরা চিকিৎসকদের নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ডের নেতৃত্বে চলছে আবুলের চিকিৎসা। আমাদের হাতে আসার আগে আবুল দু’বার ভারতে চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিলেন। সেখানকার এক ডাক্তার তাকে একটি ব্যথানাশক ওষুধ খেতে দেন! উল্লেখ্য, আবুলের হাতেপায়ে শেঁকড়ের মতো অংশগুলোর ওজনে তার হাতেপায়ে সব সময় ব্যথা করত। ভারতের ডাক্তারের ব্যাথানাশক ওষুধটি কয়েক বছর খেয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব গিয়ে পড়েছিল তার কিডনিতে! তাই এখানে তার কিডনির চিকিৎসাও দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত আবুলের হাতেপায়ে চারটি অপারেশন হয়েছে। অপারেশনকৃত হাতে পায়ে ড্রেসিং করা হয়েছে এখন পর্যন্ত ষোলবার! ছুরি নয়, এক ধরনের রশ্মি দিয়ে আবুলের হাতপায়ের শেকড়ের মতো অংশগুলো অপসারণ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পায়ের শেকড়গুলো পুরোটা অপসারণ করা যায়নি। তার প্রতিটা অপারেশন করা হচ্ছে ধীরেসুস্থে। অপারেশন করতে গিয়ে যাতে হাতপায়ের কোনো প্রয়োজনীয় শিরা কাটা বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
অপারেশনের শুরুতে ডাক্তাররা নিশ্চিত হন তার সমস্যাটি ক্যান্সারে রূপ নেয়নি। অপারেশনের পর ডাক্তাররা ভয়ে ছিলেন তার শেকড় সব আবার নতুন করে ফিরে আসে কিনা! কিন্তু আমি যখন নিয়মিত আবুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম, এর জবাবও তার কাছে পেয়েছি। আবুল আমাকে বলতেন তার বিশ্বাস সেগুলো আর ফিরবে না। আবুল আমাকে বলেছেন, ‘বারী ভাই আমার পায়ের শেকড়ের কোনো কোনোটা মাঝে মাঝে আমার লুঙ্গিতে প্যাচ খেয়ে উপড়ে যেত। তখন সেগুলো নখ দিয়ে আমি তুলে ফেলতাম। রক্ত বেরুত। রক্ত বন্ধ করতাম। কিন্তু সেগুলো আর কখনো ফিরে আসেনি।’ তার হাতে পায়ে সব সময় যে চেতনা অনুভব করতেন তাও আমাকে বলতেন আবুল।
তার চিকিৎসার সবকিছু এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই এগোচ্ছে। সবচেয়ে বড় হলো রাষ্ট্র পাশে দাঁড়ানোয় তার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে কাউকে ভাবতে হচ্ছে না। সাধারণত বাংলাদেশে কেউ কোনো জটিল অসুখে পড়লে চিকিৎসা ব্যয়, পরিবারটির ভরণপোষণ কী করে চলবে এই দুশ্চিন্তায় পুরো পরিবারটি পেরেশান হয়। আবুলের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়াতে সে দুশ্চিন্তা পরিবারটির নেই।
আবুলের শারীরিক এই সমস্যার মধ্যে হালিমা নামের একটি মেয়ে তাকে ভালো্বেসে বিয়ে করেন! তাদের একটি মেয়েও আছে। হালিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি এমন একটি ছেলেকে বিয়ে করলে কী করে?’ এসএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা করা হালিমা সলাজ জবাব দিয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল লোকটার মন খুব ভালো। তার সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য আমাকে তার দরকার।’
প্রায় সাড়ে চার বছরের দাম্পত্য জীবনে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্বামীর সেবা-শুশ্রুষাই করে চলেছেন হালিমা। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আবুলকে দাঁত ব্রাশ করানো, খাওয়ানো, টয়লেট করানো থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব কাজের জন্য স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল আবুল। এমন একজনকে জেনেশুনে বিয়ে করা, তার দৈনন্দিন সব কাজ নিজের ঘাড়ে স্বেচ্ছায় বয়ে চলা এমন দ্বিতীয় একজন মহিয়সী হালিমা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আছেন কিনা তা খুঁজে বের করতে গবেষণার দরকার আছে।
একদিন আবুলের স্ত্রী হালিমার সঙ্গে ফোনের আলাপে জানতে পারি তাদের মেয়ের ঠাণ্ডার সমস্যা কাটছে না। কারণ হাসপাতাল থেকে তাদের যে দুধ দেয়া হয় তা গরম করার পাত্র তাদের নেই। ঠাণ্ডা দুধ খেয়ে খেয়ে ঠাণ্ডার সমস্যা কাটছে না ছোট মেয়েটির। এ কথা শুনে আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে অনুরোধ করি হাসপাতালের আশেপাশে এমন কেউ আছেন কিনা যিনি আবুলের মেয়েটির দুধ গরমের একটি পাত্র পৌঁছে দিতে পারবেন। সেই পোস্টটি দেখেই যোগাযোগ করেন কাজী বাহার নামের এক প্রিয় প্রজন্ম। যিনি পুরনো ঢাকায় থাকেন। ভাইয়ের ব্যবসায় বসেন। অনুরোধ পেয়ে দুধ গরমের একটি পাত্র নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান কাজী বাহার।
এরপর থেকে তিনি এখন পরিবারটির অন্যতম সদস্য। সকাল বিকাল হাসপাতালে না গেলে তার ভালো লাগে না। আবুলকে অপারেশন-ড্রেসিংয়ের জন্যে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে পরিবারের প্রতিদিনের নানা প্রয়োজন মেটান এখন এই স্বেচ্ছাসেবী কাজী বাহার। প্রতিদিন তার আপডেট পাঠান। এ কারণে আবুলের প্রতিদিনের আপডেট জানতে পারেন দেশবাসী।
আবুল, তার মা-স্ত্রী সবসময় ফোনে আমাকে বলতেন, ‘আপনি একবার আসুন। আপনাকে দেখতে আমাদের খুব ইচ্ছে করে।’ আবুলদের কথা দিয়েছিলাম দেশে ফিরে প্রথম তাকে দেখতে যাব হাসপাতালে।
হঠাৎ সুযোগটি হয়ে যায়। গত ২৭ মার্চ আমি দেশে ফিরি ৯ বছর পর! কথা মতো বিমানবন্দরে নেমে সেদিনই ছুটে যাই হাসপাতালে। আবুলের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন আর দোয়া করতে থাকেন। তার কান্না আমারও চোখ ভিজিয়েছে। ঢাকায় যতদিন ছিলাম প্রতিদিন দেখতে চেষ্টা করেছি আবুলকে। আমি একটি নতুন জীবন পাওয়া হাসিখুশি পরিবার দেখেছি তাদের মধ্যে। যারা চিকিৎসার আশা হারিয়ে ফেলেছিল। এখন তারা স্বপ্ন দেখে নতুন এক জীবনের।
খুলনায় আবুলদের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। পুরো বাড়িটি একজন দখল করে নেয়ায় অন্য একজনের জমিতে তারা ঘর তুলে থাকেন। আবুল পরিবারের এই কাহিনী শুনে মায়ায় পড়ে গেছেন তার এক চিকিৎসক। আবুলের বাবাকে তিনি দুই কাঠা জমি দেখতে বলেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জমিটি তিনি কিনে তাদের একটি বাড়ি তৈরি করে দেবেন। আবুল এখন এমন অনেক মানুষের মায়ার মানুষ।
আবুলকে নিয়ে আমার উপলদ্ধি হচ্ছে – আমরা সবাই কারও না কারও উপকার বা কাজের লাগার চেষ্টা করি। আমাদের সব কাজ সেভাবে ক্লিক করে না। আবুলের ঘটনাটি ক্লিক করে গেছে। আবুলের পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র, প্রিয় দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই আবুল এখন আমাদের আবুল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)