চাঁদপুরের একটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তৈরি মানবসেতুর উপর দিয়ে প্রধান অতিথির হেঁটে যাওয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। অনুষ্ঠানটির প্রধান অতিথি হাইমচর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেন পাটোয়ারীসহ স্কুল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক মাধ্যমে। তবে কেউ কেউ আবার একে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা বলে অভিযুক্তদের পক্ষেও অবস্থান নেয়। এমন প্রেক্ষিতেই ফেসবুকে লিখেছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের জার্নালিজম কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র লেকচারার কাজি আনিস। “ ‘হালাল তত্ত্বের’ অসারতা ও আমার জবাব” শিরোনামে তিনি ফেসবুকে লিখেন-
“একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের পিঠে-কাঁধে পা দিয়ে এক জন প্রতিনিধির হেঁটে যাওয়ার যে ছবি প্রতিবাদের যে ঝড় তুলেছে, সেই ঝড়কে আটকানোর এক সচেতন চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ওই জঘন্য কাজটিকে হালাল করার চেষ্টায় রত আছেন বেশ কয়েকজন পরিচিত, সুধীজন, বিজ্ঞজন। একে আমি বলছি, হালাল তত্ত্ব। স্বীকার করছি, এ তত্ত্বের নেপথ্যে যুক্তি আছে। কিন্তু যুক্তিগুলো কতটা অসাড় আর মধ্যযুগীয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ, তা এ বিজ্ঞজনেরা কেন বুঝছেন না বা বুঝতে চেষ্টা করছেন না, তা আমার বোধগম্য নয়।
আগে দেখা নেওয়া যাক, যুক্তিগুলো কি? বিজ্ঞজনেরা বলতে চান, ওইটা হচ্ছে মানবব্রিজ। শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছে। এটি একটি গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলা। বহুদিন ধরে ওই স্কুলে খেলাটি মানে এ রেওয়াজ প্রচলিত। শুধু ওই জনপ্রতিনিধি নন, এর আগে অনেকেই ওইভাবে হেঁটেছেন। দোষ তাঁর নয় বা তাঁর একার নয়।
বিজ্ঞজনেরা এ ক্ষেত্রে প্রথম আলো ও কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনের রেফারেন্সও টেনেছেন যে, এ খেলা দীর্ঘদিনের। বিজ্ঞজনদের দাবি, এর সমালোচনা করে একটি ঐতিহ্যবাহী খেলাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অারেক কঠিন এক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন বিজ্ঞজনেরা। তাঁরা বলছেন, যেখানে এ খেলাটি করা হয়েছে, যে শিশুদের ওপর জনপ্রতিনিধি চড়েছেন তা তাঁরা খুশিমনে গ্রহণ করেছেন। ভিডিওতে অনেক শিশু ও উপস্থিতিদের হাস্যজ্জ্বল দেখা গেছে। বাইরে প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু গ্রামে গেলে দেখা যাবে ভিন্ন কিছু।
এবার আমি বলছি, এ যুক্তির অসাড়তা কোথায়, কোথায় মধ্যযুগীয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। প্রথম কথা হচ্ছে, এটা যে ‘গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলা’ তা কে বলল? যদি হয়েই থাকে, তাহলে কে বানালো। ওই স্কুলের কয়েক সাবেক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আসলে দীর্ঘদিন ধরে এটাকে রেওয়াজ করে তোলা হয়েছে মূলত ক্ষমতাশীলদের তোষামোদীর জন্য। যদি রেওয়াজ হয়েই থাকে, তাহলে প্রিয় বিজ্ঞজনেরা ওই জনপ্রতিনিধির বক্তব্য পড়ুন। তিনি বলেছেন, মানবব্রিজে তিনি উঠতে চাননি। যদি রেওয়াজই হয়, তাহলে তিনি উঠতে চাইবেন না কেন? যদি তাঁর ‘মানবব্রিজের উঠতে না চাওয়া’র তথ্যটি সঠিক হয়, তাহলে আমি বলব তাঁর মধ্যে কিছুটা হলেও মনুষ্যত্ব, মানবতা দেখা দিয়েছিল। যা ‘রেওয়াজ’ বানানে ওয়ালাদের চাপে তিনি আর ধরে রাখতে পারেননি।
আর কেউ বলছেন না তিনি শুধু একাই দায়ী। বরং তাঁর ছবিটিই প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ধীরে ধীরে আগের সবগুলো ছবিই প্রকাশিত হয়েছে। যারা বলছেন, আগে কথিত মানবব্রিজের ওঠা হয়েছে বলে এখন তার প্রতিবাদ করা যাবে না বা দোষ দেওয়া যাবে না-তাঁরা আর যাই বুঝুক, যুক্তি বুঝেন না। বিজ্ঞজনদের বোঝা দরকার, আগে তথ্য প্রযুক্তির এমন প্রসার ছিল না। সামাজিক মাধ্যমও ছিল না। আগের তুলনায় মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে। সূতরাং যারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেই যে সেটা জায়েজ হয়ে যাবে, আগে প্রতিবাদ না করার কারণে, তাঁরা আর যা-ই বুঝুক, যুক্তি বুঝেন না।
বিজ্ঞজনদের বোঝা দরকার, এ যে যৌতুকের বিরুদ্ধে মানুষ এত সোচ্চার, তার উৎপত্তি কিন্তু এ ‘রেওয়াজ’ থেকেই। দেখুন, এ রেওয়াজটা এখনো চলছে, ভিন্ন নামে-উপহার। খেয়াল করুন, যিনি উপহার দিচ্ছেন ও নিচ্ছেন দুই পক্ষই খুশি। তাঁদের এ আনন্দ দেখে আপনি যদি বলেন ওই ‘উপহার’ ঠিক আছে, তাহলে আপনি আর যা-ই বুঝেন, যুক্তি বুঝেন না। কারণ, তাঁদের এ আনন্দ বিষাক্ত এক সাপ হয়ে দংশন করছে সমাজকে। যার করুণ শিকার হতে হবে হতদরিদ্র পরিবারকে।
যে এলাকায় ঘটনা সে এলাকার মানুষও এটা গ্রহণ করেছে খুশিমনে, ওই এলাকায় গেলে দেখা যাবে ভিন্ন পরিস্থিতি-বিজ্ঞজনদের এ যুক্তিও ইতিমধ্যে অসাড়তায় পরিণত হয়েছে। কারণ, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন এক শিশুর বাবা। এসব কিছু বাদ দিয়ে যুক্তির খাতিরে যদি ধরেই নিই ওই এলাকার মানুষেরা খুশিমনে তা গ্রহণ করেছে-তাহলে আমি বিজ্ঞজনদের বলবো মনোবিজ্ঞান পড়তে কিংবা কোনো মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ করে নিতে। মনোবিজ্ঞান বলছে, সমাজে এমন কিছু অপরাধ ঘটে, অন্যায় ঘটে, যা দেখতে দেখতে ওই সমাজের মানুষ তা মেনে নেয়। কারণ, তার আশপাশে ওই অপরাধ থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। ইতিহাসের দিকে তাকান, সতীদাহ প্রথাকে এক সময় মনে করা হতো পূণ্যের কাজ। বলা হয়েছিল, এটা ধর্মীয় রীতি। সমাজ তা মেনেও নিয়েছিল দীর্ঘদিন। তাদের হাতে অন্য কোনো পথ ছিল না। আর ধর্মীয় রীতি বলে কথা। কিন্তু সমাজ সংস্কারকেরা যখন আসলেন মানুষ দিশা পেল। এর থেকে মুক্তি পেতে চাইল। বাতিল হলো ঘৃণ্য প্রথাটি। যারা ‘ধর্মীয় রীতি’ হিসেবে এ প্রথাকে সমাজে বিস্তার ঘটিয়েছেন তারা ব্রিটিশ আর সমাজ সংস্কারকের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ করেছিলেন যে, তাঁরা এতদিনের চিরাচরিত ধর্মীয় রীতি ধ্বংস করে দিচ্ছেন।
সূতরাং কোনো সমাজের অন্যায় আর অপরাধ যদি ব্যক্তি বাধ্যতামূলকভাবে কিংবা খুশি মনে মেনে নেন, তাহলে ওই অন্যায়টি বৈধ হয়ে যায় না। বিজ্ঞজন হিসেবে আপনার কাজ ওই অপরাধের প্রতিবাদ করা। খেয়াল করলে দেখবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রতিবাদ হয়েছে বলেই ওই স্কুলের অনেক সাবেক ছাত্র ও কয়েক এলাকাবাসী এখন প্রতিবাদমুখর হয়েছে। আর মামলাই তো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
একজন জানালেন, ওই জনপ্রতিনিধির অফিসও নাকি ভাংচুর হয়েছে। এর সত্যতা আমি জানি না। এমন ভাংচুরও কাম্য নয়। কিন্তু বিজ্ঞজনদের যুক্তি যে কতটা অসাড় তা বোঝার জন্য এটাও একটা বার্তা হতে পারে।”
গত সোমবার হাইমচর উপজেলার নীলকমল ওসমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মানবসেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে। এই ঘটনায় স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আলী আহমদ বাদী হয়ে শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের অভিযোগ এনে হাইমচর থানায় মামলা করেন। মামলার ৫ আসামির মধ্যে রয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটোয়ারী, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হুমায়ূন পাটোয়ারী, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোশারফ হোসেন, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মনসুর আহমেদ ও আবুল বাশার।