মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেননি। মানব সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা। কিন্তু এই ইবাদতের হক আমরা পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে পারি না। কিছুটা করলেও একে নামাজ-রোজা, দান-সদক্বার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। এতে ইবাদতের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো অবহেলিত হয়ে পড়ে। যদিও অনেক ধরনের ইবাদতে আমরা অবহেলা করি; কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এমন কিছু বান্দাও আছেন, যারা সার্বক্ষণিক বন্দেগির শরাব পান করে থাকেন। আল্লাহ পাক সেকথাই বলেছেন: ‘এমন কতিপয় বান্দা আছেন, ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয় যাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না’ (সূরা: নূর, আয়াত: ৩৭)।
তারা যখন ব্যবসা করেন, তাদের ব্যবসাটা কেবল নিছক ক্রয়-বিক্রয় নয়। হালাল উপার্জনের মাধ্যমে তাদের এই ব্যবসাও আল্লাহর ইবাদতে পরিণত হয়। বান্দার কাছে স্রষ্টার চাওয়াও তাই। নামাজ শেষ করেই যেন তাঁর বান্দা হালাল রিযিক তালাশে নেমে পড়ে। তাই বলেছেন, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। আর আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (সূরা: জুমআ, আয়াত: ১০)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি (রহ.) লিখেছেন, ‘এখানে অনুগ্রহ সন্ধান করার মানে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম গ্রহণ করা’। অর্থাৎ জীবিকা অর্জনের মাধ্যম গ্রহণকে আল্লাহ পাক নামাজের পরই উল্লেখ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে এর গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এজন্য প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও একটি ফরজ’ (বায়হাকি)।
ইসলাম উপার্জনে বিশ্বাসী। উদ্বুদ্ধ করেছে নিজহাতে উপার্জন করতে। আর অনুৎসাহিত করেছে ভিক্ষাবৃত্তিকে। হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে কিয়ামত দিবসে এমতাবস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না’ (বুখারি ও মুসলিম)। মানবতার খাতিরে আমাদের ধর্ম অভাবীর সাহায্যে এগিয়ে আসতে বললেও নিরুৎসাহিত করেছে কর্মক্ষম ব্যক্তির ভিক্ষাবৃত্তিকে এবং একে পেশারূপে গ্রহণ করাকে।
বৈধভাবে উপার্জন নবীগণের অন্যতম সুন্নাত। আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী নবীগণকেও হালাল রুজির নির্দেশ দিতেন, যাতে নবীগণ স্বীয় উম্মতকে হালাল রুজির পথের সন্ধান দেন। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে রাসুল সম্প্রদায়, পবিত্র রিজিক থেকে খাও এবং নেক কাজ করো’ (সূরা: মুমিনুন, আয়াত: ৫১)। তিনি আরো বলেন: ‘আল্লাহ তা’লা তোমাদের জন্য যেসব রিজিক হালাল করেছেন, তা থেকে খাদ্য গ্রহণ করো’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত: ৮৮)। নবীগণের প্রতি স্রষ্টার বিশেষ এই নির্দেশ দ্বারা হালাল উপার্জনের গুরুত্ব আরো স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। আমাদের নবীর শরিয়তেও তেমনই; হালাল রুজির বিকল্প নেই। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতেই উপার্জন করে খেতেন’ (বুখারি)।
হালাল উপার্জন অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সাথে সম্পর্ক ইবাদতের। আমরা জানি, কোনো ইবাদতই হালাল রুজি ব্যতীত মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ইবাদত কবুল হতে হলে উপার্জিত বস্তুর বৈধ হওয়া অপরিহার্য। অবৈধ পন্থায় উপার্জন করতে মহান আল্লাহ বার বার নিষেধ করেছেন। আল্লাহ পাকের বাণী: ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে আহরণ করবে না’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৯)।
নামাজ থেকে শুরু করে যত ধরনের ইবাদত আছে, সকল ইবাদত গ্রহণীয় হওয়ার জন্য বৈধ উপার্জন বা হালাল রুজি পূর্বশর্ত। হাদিস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোনো কাপড় ক্রয় করল, অথচ তাতে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত হলো। সে যতদিন ঐ কাপড় পরিধান করবে, ততদিন তার নামাজ কবুল হবে না’ (মুসনাদে আহমদ)। কেননা নামাজের জন্য কাপড় পাক হওয়া শর্ত। আর যে কাপড় অবৈধ অর্থে কেনা, তা তো অপবিত্রই হওয়ার কথা। তাই ভাববার বিষয়, আমরা প্রতিনিয়ত কি ভক্ষণ করছি, কি পরিধান করছি এবং মৌলিক চাহিদা পূরণে কী কী আহরণ করছি। নিজের অজান্তেই হারামের সাথে আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠছে না তো?
অবৈধ উপার্জনের ফল অত্যন্ত ভয়ংকর। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে শরীর হারাম খাদ্য খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (তিরমিজি)। যে সকল উপার্জন অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সমাজে দেদারছে চলছে, তার অন্যতম হলো সুদ, ঘুষ, জুয়া এবং সকল প্রকারের ধোঁকা মিশ্রিত ব্যবসা। বিশেষ করে, ধোঁকা ও ভেজাল ব্যবসার কথা অবশ্যই বলতে হয়। প্রিয় নবী (সা.) একবাক্যে বলেছেন, ‘সে আমাদের দলভূক্ত নয়, যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়’ (মুসলিম)। ইসলামে কোনো রকম ধোঁকা মিশ্রিত ব্যবসার স্থান নেই। আর বুযুর্গানে দ্বীনও বলেছেন, হালাল রুজিতে যে বরকত, হারামের মধ্যে তার বিন্দু পরিমাণও নেই।
সর্বোপরি আমাদের রুজি-রুটির জন্য বৈধ পন্থাই বেছে নিতে হবে। নয়তো দুনিয়া-আখেরাত ধ্বংসে নিপতিত হবে। অন্তত আখেরাতের সুন্দর একটি জীবন পেতে চাইলে হালাল উপার্জন অপরিহার্য।