চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

হালদা’র হালচাল

বিপাশা নামে একটা সিনেমা আছে উত্তম-সুচিত্রার, সেখানে বিপাশা নদী না- সুচিত্রা স্বয়ং। বিপাশা নদী নিয়ে উত্তম সুচিত্রার বেশ একটা ঝগড়া মতো আছে, মজার। উত্তম যখন বিপাশা নদীর বন্দনা করে কবিতা পড়ছে, তখন রুদ্রমূর্তির বিপাশা নামী সুচিত্রা হাজির হন। হালদায় বিপাশা নাই, হাসু আছে, হালদা পাড়ের কুয়াশা ঢাকা রুদ্র। ক্রমে সিনেমা শেষে যে কুয়াশা কেটে রুদ্র বের হয়ে আসে। যদিও বিপাশা টোটালি অন্যরকম সিনেমা। নদীর নাম জড়ানো বলে মনে করা গেলো। আরও দুয়েকটা সিনেমায় এমন নদীর নাম জড়ানো কিন্তু ঋত্বিক কুমার ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ও গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝির পর হালদাই তৃতীয় নদী কেন্দ্রিক সিনেমা।

তিতাস একটি নদীর নাম আর পদ্মা নদীর মাঝির থেকে এই সিনেমাটা নানা ভাবেই আলাদা আবার একই সাথে সেই দুই সিনেমার সিলসিলাও বহন করছে। আলাদার জায়গা দেখতে গেলে তিনটা গল্প তিন জায়গার, তিন কালের, সমস্যার প্রকৃতিও আলাদা। হালদা সিনেমাটা সাগরের কাছে থাকা এক নদীর গল্পে ভরা। বাকি দুই নদী সাগরের সরাসরি প্রভাব থেকে একটু দূরে থাকা। এই গল্পটা আমাদের কাছে পূর্ব পরিচিত না, যেমন উপন্যাসসূত্রে পূর্ব পরিচিত অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির গল্প। ফলে দর্শককে গল্প মাথায় করে হলে যাবার দায় থেকে তৌকির আহমেদ মুক্তি দিয়েছেন।

হালদায় ডাকাতের শিকার জেলে সম্প্রদায়
হালদা ছবির একটি দৃশ্যে ডাকাতের কবলে জেলে চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু…

হালদা সিনেমার গল্প সবচে সমসাময়িক। হালদা সেই সময়ের, যখন সারা দুনিয়ায় পরিবেশ আন্দোলনের জয়-জয়কার। হালদার সবচে শক্তি এবং দুর্বলতার জায়গা এই সমসাময়িকতা। এমন কি মনে হতে পারে, এটি জিও-এনজিও প্রজেক্টের সিনেমা। অবশ্য সিনেমা একটা প্রোজেক্ট বটে! জিও এই অর্থে বলা যে, হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রজনন ঠিকঠাক হবার জন্য সরকার সজাগ, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মাছ আহরণে। এপ্রিল থেকে জুন সময়ে হালদায় মা-মাছ ডিম দেয় সাধারণত। মাছ ধরা বেআইনি বছরের একটা অংশ।

তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মা নদীর মাঝির মধ্যে একটা তুলনা টানার চেষ্টা করা হলে দেখা যাবে তিতাস অনেক বেশি নদী কেন্দ্রিক। সৌভাগ্য, উপন্যাস হিসাবে তিতাস একটি নদীর নাম পরে লেখা হলেও সিনেমা হিসেবে তা আমাদের কাছে পদ্মা নদীর মাঝির আগে এসেছে। ফলে সিনেমার ধারাবাহিকতায় তিতাসকেই আগে রেখে আলাপ করলে বিশেষ গোস্বা করার কিছু নাই। তিতাস একটি নদীর নামের সাথে হালদার বড় মিল হচ্ছে, এই দুই ছবিতে নদীর গুরুত্ব অনেক বেশি। আর পদ্মা নদীর মাঝি আর আর আর হালদার মধ্যে মানুষের সম্পর্ক, ভাঙ্গন, প্রেম-অপ্রেম ইত্যাদি জায়গায় অধিক মিল চোখে পড়বে।

হালদা
একটি দৃশ্যে মোশাররফ করিম ও ফজলুর রহমান বাবু…

হালদা সিনেমায় আমরা দুইটা প্যারালাল গল্প দেখবো। একটা নদীর গল্প, অন্যটা প্রেমের। প্রধানত এটি প্রেমের গল্প। কুবের আর কপিলার প্রেমের গল্পের মতোই, আবার তেমন না- আরও বেশি প্রাণঘাতী। এটা নদীর গল্প। তিতাস নদীর না, হালদার। যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম দেয়। সেখানের জেলে জীবনের গল্প, জনজীবনেরও। তিতাসের মতো হালদা শুকায় না, নিয়মিত জোয়ার ভাটার নদী। তবে এখানে শিকার নিষেধ কিছুটা সময়। যদিও শিকার থেমে থাকে না। একটি ডাকাতির দৃশ্যর মধ্য দিয়ে আমরা সিনেমাটার স্টার্টিং দেখি।

প্রেম অপ্রেম মৃত্যু বিশ্বাস প্রতারণার পাশে চলে হালদার গল্প। সেটাও প্রকৃতির সাথে প্রেম ও প্রতারণার গল্প, হত্যা আর বাঁচিয়ে রাখার গল্প। কিছু ছোট চরিত্র আর একজন এক্টিভিস্টের আনাগোনা। হালদার বদলে যাওয়া প্রকৃতি, দূষণ, ডিম কমে যাওয়া, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা, নদীর প্রতি দরদ, শিকার করা মাছের জন্য কান্না, সরকারি সিদ্ধান্ত, মানুষের সাময়িক বিজয়, পরাজয়ের শঙ্কা। নদীতে একটি মেয়ে একা একা।

হালদায় একটি দৃশ্যে তিশা ও জাহিদ হাসান...
হালদায় একটি দৃশ্যে তিশা ও জাহিদ হাসান…

প্রেম- প্রকৃতির বাইরে কিছু সাব-গল্প নাড়া দেয়। যেমন হাসুর শাশুড়ি যখন তার হারিয়ে যাওয়া নাম নিয়ে আহাজারি করে। সেই বেদনা থেকে ছেলের বউকে সে নাম ধরে ডাকে। তার নাম সুরত বেগম। কেউ ডাকে না। নারীর নাম হারিয়ে যায়। নাম সবার কাছে আবুল হাসানের জন্মদাতা পিতার রুগ্নরূপান্তর নাও হতে পারে। নারীর এই বাবা স্বামী ছেলের পরিচয়ের ভিতর হারিয়ে যাওয়াটা বৃদ্ধ মানতে পারে না। তবু মানুষ তার চলার পথে নানান জায়গায় হারিয়ে ফেলে নাম। জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’ কবিতাটার কথা মনে পড়বে। নাম নিয়ে এই আক্ষেপ আমরা দেখবো তিতাস একটি নদীর নামে বাসন্তীর গলায়! নামের এই হাহাকার, পরিচয়ের হাহাকার সবখানেই- তিতাসেও, অনন্ত যেমন একটা নাম, তিতাসও তাই, নামটা রইছে নদীটা মরছে। মানুষ থেকে এই আকুতি নদীতেও ছড়িয়ে যায়, মানুষ নামে-পরিচয়ে বেঁচে থাকতে চায়। পুরুষের দুনিয়ায় মানুষ তার বংশ রক্ষা করতে চায়। এই জায়গা থেকেই হয়তো হাসুর সম্মান বেড়ে যায় যখন সে বংশ রক্ষা করবে। প্রবল প্রতাপশালী শাশুড়ি তার গলায় হার পরিয়ে দেয়। যে হার হাসুর শাশুড়িকে তার শাশুড়ি দিয়েছিল। শাশুড়ির চোখে-মুখে তার বংশ এগিয়ে নেয়ার আনন্দ। পুরুষ সমাজে উত্তর-পুরুষ না আসলে কিছুই থাকে না, এই ভয় বুড়িকে বিবশ করে। খনার প্রজ্ঞা নিয়ে বসে থাকা শাশুড়ি হয়তো সব বোঝেন। যেন মহাভারত থেকে উঠে আসা সত্যবতীর অদৃশ্য আদেশ পালন করা বদি! জাইল্লার পোলা। ব্যাসদেব। এমন লাগতে পারে। দূরবর্তী মিল।

আবার বড় বউয়ের কথাটা মাথায় লেগে যাবে, পয়সা ওয়ালারা গরিব গরতন বউ আনে কিল্লাই জান?…বউ জানি অয় পরীর মত আর কাম খরে বান্দির মত। পুরুষসমাজে নারীর এই অবস্থান খুব আয়েশি ভঙ্গিতে বলে ফেলে চরিত্ররা। এই ছবিতে দুইজন নারীকে তিতাসের নারীদের মত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে দেখি, একজন হাসু, আর একজন চৌধুরীর মা- সুরত বেগম।

এই গল্পেও তিতাসের পাড়ের সুদ ব্যবসায়ীদের মত এখানেও লাঠিয়াল আছে, ডাকাত আছে, মহাজনের মত চৌধুরীরা আছে। এখানেও পদ্মা পাড়ের শীতল বাবু আছে, যে মাছ নিয়ে দাম দেয় না। হালা ডাকাইত। সে চৌধুরী নিজে। যখন দেখি হালদার মাছ বলে হাসুর বাপেরে দৌড়ানি দিয়ে নিজে মাছটা নিয়ে নেয়। এটা যেন শীতল বাবুরে দেখা। এখানেও ডাকাত আছে, তিতাসে বউ ডাকাতি হয়। সমস্ত সর্বনাশ যেন সেখানেই! বউ হারিয়ে কিশোর পাগল হয়। হালদার প্রথম দৃশ্যই ডাকাতির। নদীর কাছের মানুষ যে লোকজ ধারার ব্রত পালন করে তা আমারা তিতাস একটি নদীর নামে দেখি, তিতাসের শুরুর দিকেই মাঘকুড়ুলির ব্রত। হালদায় ব্যাঙের বিয়ে। এইসব মিল ভালো লাগে। উত্তর-উপনিবেশিক জায়গা থেকেও এসব গুরুত্ব বহন করে। এটা বাংলাদেশের গল্প। নদীর কাছের মানুষের গল্প, প্রাকৃত মানুষের।

চৌধুরী প্রবল প্রতাপের মানুষ। তার অবৈধ ইটভাটা, অন্যান্য ব্যবসা। তাকে সরকারি আমলাদের ঘুষ দিয়ে, মাস্তান লাঠিয়াল দিয়ে নানান কুকীর্তি করে টিকে থাকা দেখি, তবু শেষে তার পরিনতি পরাজয়ে। মৃত্যুতে। নারীকে নৌকায় বৈঠা হাতে অনেক বেশি সাবলীল দেখি। এই নারী কে? এই নারী কি হালদা রক্ষা কমিটি? প্রায় অক্ষম, রাবীন্দ্রিক- হালকা প্রতিবাদী? হালদা সংরক্ষণে ইট ভাটা সরানোর হুকুম জারি হতে দেখি আমরা। ইট ভাটায় জ্বলতে দেখি বদিকে। লাল্টু নামে এক সিরিয়াল কিলারের কথা স্মৃতিতে আসে, যে ইট ভাটায় মানুষ পোড়াত। ইট ভাটা কি তবে এখানে মানুষ পোড়ায়? বদিকে জ্বালিয়ে দেয়া কি দখলদারদের মরণ কামড়? দেয়ালে পিঠ লাগলে ঘুরে দাঁড়ায় মানুষ, হাসু যেমন! দাঁড়ায় কি আসলে? এমন প্রশ্নের ভেতর দিয়ে চাইলে আপনি যেতে পারবেন।

হালদা কিছু প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ দেয়। ইতিমধ্যে সেসব নিয়ে আলাপ শুরু হয়েছে, স্বল্প পরিসরে হলেও। যেমন-ভাষা। আমি যেহেতু চাটগাইয়া না তাই সেখানের আসলি উচ্চারণ আমার পক্ষে ঠাহর করা কঠিন, অ-চাটগাইয়া প্রায় সবার জন্যই তাই। ফলে চাটগাইয়াদের কানে নাকি ভাষাটা বেশ আটকেছে! দুইটা জায়গা থেকে দেখা যায়, সংলাপ লেখা এবং অভিনেতাদের থ্রোয়িং। দুই জায়গাতেই গলদ থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর একটা জায়গা হল সিনেমাটায় প্রেমের গল্পের প্যারালালি হালদার রক্ষার যে আন্দোলন। সেখান থেকে দেখলে মনে হতে পারে এটা পরিবেশ রক্ষার যে বিশ্বব্যাপী এনজিওবাদী আন্দোলন আছে এটা তার ধারাবাহিকতা এবং এখানে যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে ভাষায় অন্যদের থেকে অনেক বেশি ‘প্রমিত-চশমাধারী-ভদ্রলোক’। যেন অফিস করছে! গণআন্দোলনকারী নয়, বরং একজন ‘ভদ্র লোক’কে দিয়ে আন্দোলন সংগঠনের দায়িত্ব নিতে দেখি এই সিনেমায়। এগুলো যেন নাগরিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের মফস্বলি সংস্করণ!

হালদা’র শুটিং চলাকালী সময়ে জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমের সাথে তৌকীর
হালদা’র শুটিং চলাকালীন সময়ে জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমের সাথে তৌকীর

দক্ষিণের মানুষ এবং প্রকৃতির গল্প, তাদের লড়াইয়ের গল্প, আমাদের সাহিত্যে খুব কম। অন্তত গল্প উপন্যাসে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধ সামরিকায়ন হত্যা ইত্যাদি প্রবন্ধ নিবন্ধে যতটা এসেছে, ফিকশনে ততটাই কম। কম সেই দিকের জনপদ কেন্দ্রিক আখ্যান। শহিদুল্লা কায়সারের ‘সারেং বউ’ আর আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রায়-অখ্যাত ‘কর্ণফুলী’ই উজ্জ্বলতম!! উল্লেখ করা দরকার দুটার একটাও বাংলাদেশ পর্বের না! ভিডিওতে ‘কর্ণফুলীর কান্না’ (ননফিকশন) বা ‘মাই বাইসাইকেল’ কম প্রচারিত সাম্প্রতিক সংযোজন। হালদা উল্লেখিত দুই ছবি থেকে আলাদা এবং উজ্জ্বল। বাংলাদেশের পর্বের গল্প, যা বিশেষ মাজেজা ধরে।

হালদার ভিডিওগ্রাফি মনে রাখার মত, ল্যান্ডস্কেপ সাউন্ড মিউজিক আপনাকে টানবে। মুভিতে টপ্পা ঠুমরীর ব্যবহার আশ্চর্য রকম মানিয়ে গেছে। ফজলুর রহমান বাবু ,জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিমের অভিনয় চরিত্রের সাথে মানানসই ছিল, তিশাকে এক্সট্রা অরডেনারি লেগেছে, এই বয়সেও দিলারা জামান দুর্দান্ত। সিনেমাটা কতটা ব্যর্থ হল সেটা সময় বলে দেবে। তবু এক দেখার পর মনে হচ্ছে, তিতাস একটি নদীর নাম আর পদ্মা নদীর মাঝির পাশে মানুষ হালদাকে জায়গা দিবে।