চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

হাথুরুসিংহের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক বড়

জিম্বাবুয়েকে তখন মাঝেমধ্যেই হারানো যাচ্ছিল। কিন্তু ভারত, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশসহ টানা পাঁচটি ওয়ানডে সিরিজ জয় দেশের মাটিতে। সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের পর শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই সিরিজ ড্র। সাফল্যের খতিয়ান এখানেই শেষ নয়। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছে মাশরাফীরা। ধারাবাহিক সাফল্যের পথে মাঠে আসল কাজটা ক্রিকেটাররাই করেন, কিন্তু অন্য যে নামগুলো না টানলেই নয় সেগুলো কোচিং স্টাফদের। বিশেষ করে চণ্ডিকা হাথুরুসিংহের নামটা আসবেই, লাল-সবুজের ক্রিকেটের সোনালী এই সময়ের প্রসঙ্গ টানলে কড়া হেডমাস্টারের ভূমিকায় পাওয়া যাবে তাকে। যার সঙ্গে মাশরাফীর যুগলবন্দীতে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই হাথুরুসিংহে পরের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে আরও উঁচুতে তুলে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেজন্য সবরকম সহায়তাও করছিল বিসিবি। অথচ বৃহস্পতিবার দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটির প্রধানকে বলতে হল, কেউ (পড়ুন হাথুরুসিংহে) যদি থাকতে না চায় তাকে জোর করে রাখতে চাইবে না বিসিবি। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান এমপি সন্ধ্যায় এমন মনোভাবই জানিয়ে দিলেন। কারণ দুপুর থেকেই চাউর হয়ে গেছে বোর্ডের কাছে জমা পড়ে আছে হাথুরুসিংহের পদত্যাগপত্র। সেটা আবার জানা গেল মাসাধিক পর। হাথুরুসিংহে বিসিবিকে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন আসলে সেই ১৫ অক্টোবরের দিকে। সাউথ আফ্রিকা সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট চলাকালীন সময়ে। বিসিবির সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই। আগেও এমন হয়েছে, তখন দুপক্ষ আলোচনা করে সমাধান করেছে। কিন্তু এবার বোর্ড সভাপতির মন্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে তাল-লয়ের সঙ্গে সুরটা কেটে যাওয়ার! বিসিবি সভাপতি যদিও বলছেন, হাথুরুর সিদ্ধান্তটা আবেগতাড়িতও হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই আশাহত হওয়ার মতো তথ্য মিলছে। বারবার চেষ্টা করেও যে হাথুরুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না বিসিবি। কোচের মোবাইলও বন্ধ। একটা পদত্যাগপত্র দিয়ে ওভাবে ডুব মেরে থাকাটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না বিসিবিও। নতুন বছরের জানুয়ারির পর শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ার ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছেন হাথুরু, লঙ্কান ক্রিকেটের প্রতিনিধিরাও জোর গলায় বলছেন এমনটা। দুয়ে-দুয়ে চার মিলিয়ে এবার হয়ত আর আবেগতাড়িত নয়, প্রফেশনাল পথেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে হাথুরু অধ্যায়ের সমাপ্তির আভাস। যদিও এভাবে চলে যেতে চাওয়া কোন প্রফেশনালিজমের মধ্যে পড়ে কিনা প্রশ্ন তোলাই যায়। হাথুরুকে নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। তিনি দল পরিচালনায় কারও কথা শোনেন না, চাহিদাপত্রের সীমা নেই, অধিনায়ক ও ম্যানেজমেন্টকে পাশ কাটিয়ে দল গড়েন, বেশিরভাগ সময়ই ছুটিতে থাকেন, কোন সিরিজের আগে আগে এসে সিরিজ শেষের পরের দিনই ছুটিতে যান, ঘরোয়া ক্রিকেটে নজর রাখেন না, দেশে বসে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন বিসিবিকে, নিয়মিতই খবর হয় তার ওপর নাখোশ অনেক পক্ষই; এরপরও সেই হাথুরুকেই আবার একচ্ছত্র আধিপত্যে দেখা যায়। কারণ বিসিবিই তাকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা যখন টানা এমন সুযোগ দিয়ে থাকে, সেটা নিশ্চয় একেবারে ভাবনাচিন্তা না করে দেয়া নয়। কোচের ওপর এই আস্থাটা রাখা যায় বলেই লাগামছাড়া স্বাধীনতা দেয়া। সেজন্যই হাথুরুর প্রস্থানে প্রথমত বড় একটি ধাক্কাই খাবে বিসিবি ও দেশের ক্রিকেট। কড়া হেডমাস্টার হাথুরুর চাওয়ার মতো করে স্বাধীনচেতা পরিবেশ তৈরি করে দেশের ক্রিকেটে তার আধিপত্যের একটা জায়গা গড়ে দিয়েছে বিসিবি। তিনি একইসঙ্গে প্রধান কোচ, নির্বাচক কমিটির অংশ, আবার দল পরিচালনার অঘোষিত সর্বেসর্বা। টাকা দিয়ে একজন নতুন কোচ হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু সম্পূর্ণ হাথুরুকেন্দ্রিক একটা পরিবেশে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে নতুন কোচে অধীনে দল কতটা গুছিয়ে ওঠার সময় পাবে প্রশ্ন এখন সেটাও। সেটাই আবার দলের জন্য চ্যালেঞ্জেরও। বাংলাদেশ ক্রিকেট তো নতুন যুগে প্রবেশ করেছে কয়েকবছর আগেই। বড় দল হয়ে ওঠার এটাও যে একটি শর্ত, কোন অন্তরায়ই প্রফেশনালিজমে ধাক্কা দিতে পারে না। মাশরাফীদের সেই চ্যালেঞ্জটাই নিতে হবে, প্রমাণ করতে হবে উন্নতিটা ধরে রেখে। হাথুরুসিংহে আর ফিরুন না ফিরুন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে থাকুন না থাকুন, সেটার থেকে অনেক বড় বিষয় দেশের ক্রিকেটে উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। আদতে কেউই কখনো চিরস্থায়ী নয়, একদিন হাথুরুকেও চলে যেতে হতো; সেটাই হয়তো ক’টা দিন এগিয়ে আসতে পারে তিনি সিদ্ধান্তে অটল থাকলে। তাতে একেবারে নাই নাই রব তোলার যেমন কিছু নেই, আবার আছে সতর্কতার অনেক জায়গাও। বিসিবি দ্রুত কাউকে দায়িত্ব সঁপে বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করে দল গুছিয়ে তোলার সুযোগ দেবে এটাই কাম্য। সেইসঙ্গে চলে যেতে চাওয়া কোচ প্রকৃতই চলে গেলে তার মহাপরিকল্পনাগুলো একেবারে ছুঁড়ে না ফেলে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা হবে বলেও প্রত্যাশা। হাথুরু-অধ্যায় তো টাটকা স্মৃতিই, ক্রিকেটপাঠ বলবে তার সাফল্যমণ্ডিত সময়ের গল্পই। শেষটা যেভাবেই হোক, ধন্যবাদটা হাথুরুসিংহেরও প্রাপ্য। বিসিবিই কোচকে বাড়তে দিয়েছে। তাদের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনার অনেক জায়গা আছে। আপাতত তারা পরিস্থিতি ঠিকভাবে সামলাবে সেটাই প্রত্যাশার। আশা করা যায় বোর্ড ক্রিকেট অভিভাবকত্বের পরীক্ষায় বিচক্ষণার পরিচয় দেবে। যাতে অগ্রাধিকার পাবে শুধুই ক্রিকেট-স্বার্থ। কেননা, হাথুরুসিংহের চেয়েও বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক বড়।