তিন দেশের সিরিজ। ক্রি ক্রি ক্রি ক্যাট। বাংলাদেশ ক্যাট যদি জোরে শোরে একবার ম্যাঁয়াও বলে গর্জন করে ওঠে, জিম্বা হয়ে যাবে বুয়ে। কিন্তু প্রথম খেলাটি পড়লো হাততু ভায়ার শ্রীলংকার সাথে। ভেবেছিলাম, আমরা জিতবো তবে জব্বর জোর লাগবে। হায়রে সে খেলায় যে শ্রীলংকা এমন লবডংকা ছাততু হয়ে যাবে ভাবতেও পরিনি। তখন আর এই অতিসত্বর সত্তর সীমান্তে পৌঁছুবার প্রবীণ (বুড়ো নয় কিন্তু!) আমাকে পায় কে!
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, আমাকে মাফ করবেন। শ্রীলংকা নিয়ে আমাদের দেশে যে বহুকাল ধরে মাতামাতি চলে আসছে, সেটা দেখে বরাবরই এই অধমের চিত্তি পিত্তির বাত্তি একযোগে জ্বলে ওঠে। তবে অবশ্যই তার কার্যকারণ আছে। কথায় কথায় ঊনিশশো একাত্তরের কথা তুললে দেখি অনেকে বিরক্ত হয়ে যান। একাত্তর জুড়ে জাহাজ ভরে ভরে পাকিস্তানি অস্ত্র এসেছে কলম্বো হয়ে। কলম্বো বিমানবন্দর হয়ে বড় বড় বিমানে হানাদার হিংস্র পাকি সৈন্য প্রজাতিকে বাংলাদেশের রণক্ষেত্রে নিয়ে আসার ফুরসৎ করে দিয়েছে শ্রীলংকা সরকার। বাজারে এই সত্য নিয়ে তেমন কথা কিংবা বার্তা নেই বললেই চলে।
আসলে প্রতিবেশী বিশাল ভারতের সঙ্গে শ্রীলংকার হৃদয়ে সদ্ভাব কখনো নেই, ছিলোনা। অতএব পাকিস্তানি দোস্তালীর জন্য ওরা নীতি, নৈতিকতা, ইমান সব হারিয়ে আমাদের মহান একাত্তরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করার কাজে নেমেছিলো। বিশ্ব ক্রি ক্যাট ১৯৯৬ সনে শ্রীলংকা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করলেও আমাকে তা তেমন করে ছোঁয়নি। এদিকে সে সময় ভারত কুপোকাত চিৎপাত হলে দেখেছি একাত্তরের পক্ষ বিপক্ষ নির্বিশেষে বাংলাদেশওয়ালাদের অধিকাংশ উল্লাসে আহ্লাদিত।
সে যাক। ২০০৬ সনে একবার কলম্বো গেলাম। দক্ষিণ এশিয়া মার্কা এক আয়োজনে। বেড়াতে যাচ্ছিলাম বাসে ওদের ক্যান্ডি শহরে। পথে এক জায়গায় জাগতিক প্রয়োজনে থামলো বাস। পথের ধারের কাফে জাতীয় ছোট্ট ঘরে ঢুকলাম। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম বাংলাদেশ-শ্রীলংকা খেলার লাইভ কারবার। আমাদের দলটির খুবই কাহিল দশা। কাফের মালিক লোকটা বুঝলো আমরা বাংলাদেশের লোক। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগছেনা। খোঁচাটা বুঝি ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর ভেদ করে আমার হৃদপিণ্ড ছেদ করে ফেলল। শ্রীলংকা জুড়েই ইংরেজি ভাষার ফুরফুরে দাপট। সে লোকটি খুবই ‘সুশীল’ কায়দায় এই অশ্লীল আঘাত হানলো। তখন আমি বাংলাদেশের কোটি কোটি লোকের মান ইজ্জতের একমাত্র প্রতিনিধি সেখানে। খুবই গরম মাথায় এক টন বরফ তাৎক্ষণিকভাবে ঢুকিয়ে বললাম, না ভাই তেমন খারাপ লাগছেনা। একসময় শ্রীলংকা ক্রিকেট দলটির ডায়রিয়া-ডিসেন্ট্রির ইতিহাস কিঞ্চিৎ জানা আছে। সেখান থেকে তোমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছো। তাতে শরীরের বিশেষ অংশ ভারি হলেতো চলবেনা। তোমাদের সেই ক্রিকেট কোচ হোয়াটমোর তোমাদের চ্যাম্পিয়ন করিয়েছে, তিনিই এখন বাংলাদেশের কোচ। অতএব হেলায় হেলা করিওনা। কাফে মালিক কিঞ্চিৎ চুপসে গেলেন মনে হলো। সেটুকুই ছিলো আমার সেদিনের ক্ষুদ্রতম বিজয়।
সেই ২০০৬ থেকে এখন ২০১৮। আমাদের ক্রি বিড়াল এখন মাঝে মধ্যেই ক্রি ব্যাঘ্রের যে গর্জন তুলছে, তা আমাদের দেশের ক্রি ত্রিশংকু অবস্থানকে রীতিমত বিশ্ব প্রশংসার সম্মানে বিভূষিত করে চলেছে। আমাদের দেশে যারাই আসে, লেজ গুটিয়ে পালায়। পরাজয়ের অপমানে পৃথিবীর সব দেশই জর্জরিত হয়ে যায়। ওদিকে আমাদের জন্যই একবার ভারত, আরেকবার বিলাত বিশ্বকাপের রণে মাঝপথে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলো। সেদিন নিউজিল্যান্ডও সেমিফাইনালে উঠতে না পেরে চ্যাম্পিয়নশিপ আসরের কোয়ার্টার পিয়ন বলে গেলো। শ্রীলংকায় আমাদের শততম টেস্টে যেদিন খোদ কলম্বোতে আমরা শ্রীলংকাকে ঘোল খাইয়ে দিলাম, সেদিন আমার ঐ কফিওয়ালা শ্রীলংকার কাফে মালিকের কথাই মনে পড়লো।
শ্রীলংকার এককালীন মাঝারিমানের ব্যাটসম্যান হাততু ভায়া। স্বদেশে ক্রিকেট ঘটুমটু খুটমুটে কোন দাম না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। অবশেষে সেখানে রাজ্য পর্যায়ে ক্রি কোচ বনে যান উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করে। বাংলাদেশেরও কোচ ভাগ্য তেমন ভালোনা। একজন আসেনতো বেশিদিন থাকেননা। আরেকজন আসেন। তথৈবচ। এমনি সময়ে কোনো এক ফাঁকে আমরা শ্রীলংকার হাততু ভায়াকে দীর্ঘসময়ের জন্য পেয়ে গেলাম।
আর সাথে সাথেই বুঝি পেয়ে গেলাম কোচিং-এর জাদুর কাঠি। ওই জাদুর কাঠির এক নম্বর কাজ ছিলো তার স্পর্শে স্পর্শে ক্রিকেটারদের প্রতি রোমকূপ দিয়ে ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখিত ‘আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা’ প্রবন্ধের মর্মবাণী প্রবেশ করিয়ে দেয়া। সত্যি সত্যি হাততু জাদুর কাঠির স্পর্শে ঘটে গেলো রাসায়নিক বিপ্লব। পৃথিবীর তাবড় তাবড় বিশাল ক্রিকেটাররা বঙ্গময়দানের ক্রিজে এসে একের পর এক নাকানি এবং চুবানি খেতে থাকলো। আর সারা ক্রিকেট দুনিয়াকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত অজুহাত, অজুঠ্যাং, অজুনাক দেখিয়ে বঙ্গদেশ সফরে না আসার ক্যারিকেচার করতে থাকলো। একদিন অবশ্য তারাও এলো। তেমন সুবিধা করতে পারলো না অস্ট্রে ভ্রাতঃগোষ্ঠী পর্যন্ত।
সারা পৃথিবীকে পুঁচকে গোঁফের ক্রি বেড়াল বাংলাদেশ যখন এমনি হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় অবস্থায় ফেলে ক্রি টাইগারের সম্মানে ভূষিত হতে থাকলো, জগতের কাছে হাততু মিয়ার জাদুর কাঠির শেয়ার দরও বাড়তেই থাকলো। যে হাততুকে একদিন তার দেশ শ্রীলংকা অপমান করে কার্যত বের করে দিয়েছিলো, সেই হাততুর কাছে কতো যে অনুনয় বিনয় করে যাচ্ছিলো গোপনে গোপনে। এসো হে হাততু, অতীতের মান অভিমান ভুলে যাও, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো। বাংলাদেশের সাথে ২০১৯ সাল বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি? ওসব অঙ্গীকার গুঁড়ো গুঁড়ো করে এক্ষুনি চলে এসো ভ্রাতঃ হাততু। এই কান ধরি, আর কখখনো এমনটা করবোনা। তুমি এসে হাল ধরো শ্রীলংকা ক্রিকেটের বিপন্ন তরীর।
আমাদের মাঝে একটি কথা চালু আছে। লোকটি প্রফেশনাল, মানে লোকটি নিরাবেগ, অনুভূতিহীন, হৃদয়বত্তাবিহীন। যে হাততু আত্মবিশ্বাসের স্বল্পতায় ভোগা একটি দলকে এমন সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং মারকুটে করে তুলেছেন, তার প্রতি কী যে ভালোবাসার প্লাবন বয়ে গেলো বাংলাদেশের হৃদয় জুড়ে। আর সেই হাততু, বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগল কোটি মানুষের হৃদয়কে পৃথিবীর বৃহত্তম বল্লম দিয়ে আঘাত করে নির্বিকার থেকে, এতটুকু পাত্তা না দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে গেলেন দল ছেড়ে! এমন ‘প্রফেশনালিজমকে’ হাজার বছর ধরে নিকুচি করি।
খুব রাগ হলো। জেদ হলো। বাংলার টাইগাররা এবার হাততুকে দেখিয়ে দিক এক হাত নয় একশ হাত। প্রথম খেলাতেই শ্রীলংকাকে এমন কাততু করে দিলো বীর বাঙালির দল যে নীরব উল্লাসে ফেটে পড়লাম। কিন্তু হায়, এরপরই কী যে হলো। হাততুকে খুবই উপেক্ষা করেছিলাম। হাততু জানতেন আমাদের দুর্বলতার ফাঁক ফোঁকড়। খেলোয়াড় ধরে ধরে। হাততু জানতেন শ্রীলংকার খেলোয়াড়দের কোথায় কোথায় শক্তিমত্তা। একেবারে কম্পিউটার ডিজিটাল হিসাব।
এই জায়গাটিতে হাততু আসলেই জাদুর কাঠি হাতে নেয়া প্রফেশনাল। নিজের প্রাথমিক কাঁচা উল্লাসের জন্য নিজেকে ভৎর্সনা করলাম। বাংলাদেশ দলের নব্য গজিয়ে ওঠা ম্যানেজার সাহেবরা ভেবেছিলেন, হাততু আবার কী! ওদেরকে দাঁড়াতেই দেবোনা।
কিন্তু হায়! আমরা যে তারপর বসেই গেলাম। নিজেরাই দাঁড়াতে পারলাম না হাততুর ক্রিকেট অংকের বল্লমের সামনে। খালি পাত্র বাজে বেশি- আমাদের ক্রিকেট কর্তারা তা বুঝিয়ে দিলেন সরাসরি। বাঙালি নাচন ভুলে গেলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো হিসাবী ক্রিকেটের সামনে।
হাততু আমাদের অমূল্য শিক্ষা দিলেন। হাততু জাতীয় পর্যায়ের কোচ প্রথম হয়েছিলেন বাংলাদেশেই। সেই বাংলাদেশকে ধোঁকা দিয়ে আশাহত করে চলে গেলেন। কিন্তু আমাদের তো হাল ছাড়লে চলবে না।
হাততুকে জবাব দিতেই হবে। হাত্তুর হাতে কাততু হয়ে গেছি। তাতে কী! মনোবল জোগাড় করে ফের দাঁড়াবো আমরা। নতুন কোচ আসবে আমাদের। নতুন মনোবল। নতুন উজ্জীবন। হাততুকে আমরা অচিরেই কাততু করে দেবো! এই মনোবলের ঘোষণা দিয়ে একাত্তরের বিদ্রোহী মার্চের রূপকথার প্রতি সম্মাননা জানালাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)