হাওড়পাড়ের ফসল রক্ষা বাঁধের বরাদ্দ প্রতিবছর লুটপাট করে চলেছে একটি অসাধু চক্র। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওড়গুলো যদি উপযুক্ত সময়ে কর্তৃপক্ষের সুনজরে ও গুরুত্বে থাকতো তাহলে প্রতিবছর হুলস্থূল হতো না। বাঁধ ডুবে যায়, খবর হয় সংবাদপত্রে। লুটপাট হয় সরকারি বরাদ্দ আর কৃষক বাধ্য হয় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে মাটি কাটতে। এলাকায় মাইকিং করে বলা হয় যার যা আছে তা নিয়েই ফসল রক্ষা বাঁধে চলুন। সরকারি বরাদ্দ নয়ছয় করে পুকুরচুরি করবে সুবিধাবাজ বিত্ত আত্মসাৎকারীর দল ।তারা বাঁধের ধারে কাছেও আসবে না আর বিনা পারিশ্রমিকে মাটি কাটবে নিরীহ কৃষক, মজুর,রিকশাওয়ালা ও ভ্যানওয়ালা।
সুবিধাবাজরা মুখ টিপে হাসবে কারণ এইসব নিরীহ মানুষদের স্বেচ্ছাশ্রম ও হুলস্থূলই তাদের লুটপাটের ধারাবাহিকতার জন্য খুব সহায়ক হয়। কারণ এতে নতুন বরাদ্দ আসবে আর সুযোগ হবে আরও নতুন করে লুটপাটের।
২৮ মার্চ, ২০১৮ দৈনিক যুগান্তর তার সম্পাদকীয়ের শিরোনাম করেছে: সুনামগঞ্জের ফসল রক্ষা প্রকল্প/বাস্তবায়নকারীদের সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। সম্পাদকীয়টিতে লিখেছে, সুনামগঞ্জের ফসল রক্ষা প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণে, কম দরে মাটি কেটে বেশি দরে বিল উপস্থাপন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘাস লাগানো ও মাটির স্থায়িত্ব (কম্পেকশন) টেকসই করা বাবদ আলাদা টাকা দেয়া হলেও সেটি করা হয়নি।আশ্চর্যজনক হল, ১৭৭ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় শেষে দেখা যাচ্ছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন বাকী ১১১ কোটি টাকার বিল তুলে নিয়ে পকেটস্থ করার তোড়জোড় চলছে। ২০১১-১২অর্থ বছরে হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার ৭০৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করে। এই ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে এ প্রকল্পের মাত্র ২৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়। উন্নয়ন বরাদ্দের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবের জন্যই প্রতিবছর আগাম বন্যায় পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষকের ফসল।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের আহাজারিতে বন্যার জল আর কৃষকের চোখের জল একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়, আলোচনা-সমালোচনা হয়। নতুন বরাদ্দ আসে। কিন্তু লুটপাট হয়ে যাওয়া পুরান বরাদ্দ উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বরং সৃষ্টি হয় আরও নতুন বরাদ্দ লুটপাটের সুযোগ। হাওড় পাড়ে ‘সরকারী মাল দরিয়ামে ঢাল’এই অব্যবস্থা আর কতদিন? হাওড় পাড়ের মানুষদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। বৈশাখ মাস এসে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ দেখলেই কেঁপে উঠছে কৃষকের বুক। গতদিনে বেশ কয়েকবার চৈত্রের শেষদিকেই আগাম বন্যায় ডুবিয়ে নিয়েছে তাদের কাঁচাপাকা ধান। সারা বছর প্রশাসন থাকে নির্বিকার। সময় থাকতে আন্তরিকভাবে তৎপর হলে কৃষকদের ফসলহানি হতে রক্ষা করা যেত। কেন হাওড় পাড়ের বরাদ্দগুলো লুটপাট হচ্ছে আর প্রতিবছর কৃষকের ঘটছে সর্বনাশ?
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক কর্মকর্তা জনরোষে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু এই পালানোতে কী লাভ হল হাওড়পাড়ের কৃষকের? যে বরাদ্দ লুণ্ঠনের জন্য তারা পালালো তা কি উদ্ধার হল? বারবার নতুন বরাদ্দ ও বারবার লুণ্ঠন এভাবে আর কতদিন? লুণ্ঠিত বরাদ্দ উদ্ধারের কি কোন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে না? কেন নেয়া যেতে পারে না? এই উদ্যোগ না নেয়া কি লুণ্ঠনকারীদের রক্ষার সহায়ক নয়? কী করছে উপজেলা, জেলা প্রশাসন,কী করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড? কী করছে দুদক? এছাড়াও হাওড়পাড়ের মানুষের ভোটে রয়েছেন নির্বাচিত মেম্বার, চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য। ফসল ডুবে গেলে তারা হাজির হন। সারা বছর হাওড়ের মানুষের খোঁজ না নিয়ে হুলস্থূল সৃষ্টি করা ফসল ডোবার সময়! কেন?
প্রতি বছর হাওড়পাড়ে সরকারী বরাদ্দ ও কৃষকের ফসল একযোগে ডুবে চলেছে। এখানে যেমন ফসল উদ্ধারের কোন সুযোগ নেই ঠিক তেমনই যেন কৃষকের জন্য সরকারের দেয়া বরাদ্দ উদ্ধারেরও কোন সুযোগ নেই। প্রতি বছর হাওড়পাড়ে শোনা যায় কৃষকের কান্না। এ কান্নার পাশাপাশি চলে কতিপয়ের মায়াকান্না। আরও আছে বরাদ্দ আত্মসাৎকারী ও তাদের সমর্থন ও প্রশ্রয় দানকারীদের মুখ টেপা হাসি। তবে কি এটাই নিয়তি হয়ে গেল? এসব বরাদ্দ উদ্ধার না হলে লুটেরাদের সিন্ডিকেট যে চির মজবুত চেয়ারে বসে পা নাচাবে আর জয়ের হাসি হেসেই চলবে এতে দ্বিমত আছে কার?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।