পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যায় দেশের সবগুলো হাওর প্লাবিত হওয়ার মূল কারণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দুষলেন।
তাদের মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণেই ডুবছে হাওর, ভেসে যাচ্ছে ফসল, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। কাঁচা-পাকা ধান পানিতে পঁচে পানিদূষণ জনিত কারণে মৎস্য সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সরকারকে আরো স্পষ্ট বক্তব্য দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
মৌলভিবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘হাওরের বাঁধ যেভাবে নির্মাণ করা হয় তার কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। যে কারণে সামান্য পানির স্রোতেই বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ফলে মুহূর্তেই হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যায়।
‘এই বাঁধগুলো যদি শক্তভাবে ভাল উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা যায় তাহলে বন্যায় কিছু হবে না,’ দাবি করে তিনি বলেন: আকস্মিক বন্যা যেহেতু হাওর অঞ্চলের নিত্যসঙ্গী তাই সঠিক পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণই পারে আকসিম্ক বন্যা ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ঠেকাতে।
সরকারি পদক্ষেপের বিষয়ে সৈয়দা সায়রা মহসিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও হাওর অঞ্চলের মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আলমগীর চেীধুরীও দুষলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডকেই।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: বাঁধ নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড তার অপব্যবহার করে থাকে। যে কারণে দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে দাড়িয়ে থাকা বাঁধগুলো ভেঙ্গে মুহূর্তেই তলিয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল।
‘হাওরাঞ্চল মূলতঃ এক ফসলি,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকরা শুধুমাত্র বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল।
ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষকদের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, এখন বিনাসুদে কৃষি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে তিনি সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুল রহমান মেজবাহ হাওরে ফসলহানির সঙ্গে সঙ্গে মাছের মড়ক লাগার বিষয়টিরও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মনে করেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সম্প্রতি সুনামগঞ্জে হাওরে যে ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে এবং এ কারণে মাছে যে মড়ক লেগেছে তাতে পারমাণবিক শক্তি কমিশন বলছে, সেখানে কোন তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ মেলেনি। আর তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ যদি না মেলে তাহলে কী কারণে এমন হচ্ছে সে বিষয়টা স্পষ্ট করে বলা দরকার।
‘হাওরে ফসলহানির ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু মাছের মড়ক একেবারেই নতুন একটি ঘটনা।’
তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদল এটাও বলছে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে মাছে মড়ক লেগেছে। যদি তাই হয় তাহলে অক্সিজেনের স্বল্পতা কেন হল সেটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার। তা নাহলে স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন প্রচলিত গুজবে কান দেবে এবং তার দ্বারাই প্রভাবিত হবে।
সুনামগঞ্জে যাদের ফসলহানি হয়েছে তাদের বিকল্প কোন কাজ নেই। ধান ও মাছই এখানকার প্রধান সম্পদ। আগামী বোরো ধান ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের অায়ের কোন পথ থাকবেনা উল্লেখ করে পীর ফজলুল রহমান মেজবাহ পরামর্শ: সব হারানো কৃষকদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী চালু এবং ব্যাংক ঋণ মওকুফ।
ভবিষ্যতে এ ধরনের অবস্থা এড়াতে হাওরগুলোকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমের ওপর জনগণের আস্খা হারিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন: বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাদ দিয়ে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমানের কণ্ঠে অবশ্য কিছুটা ভিন্ন সুর।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছি, ঠিক তেমনি প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে বিরূপ অাচরণ করছে।’
তিনি বলেন: গাছপালা কেটে রাস্তা নির্মাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে প্লাবিত হচ্ছে হাওর অঞ্চল। মৌলভীবাজারের মনু, হবিগঞ্জের খোয়াই, সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সামান্য বেড়ে গেলেই প্লাবিত হয় আশপাশের এলাকা। দুর্বল বাঁধ দিয়ে এ পানির প্রবাহকে আটকানো যাচ্ছে না। যার ফলে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মারাত্মক খাদ্যসংকটের মুখে পড়বেন এ অঞ্চলের কৃষকরা।
তাদের পুনর্বাসনের জন্য মহাপরিকল্পনা নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আর না হলে অচিরেই আমরা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো।’