হাওরে ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তার কোন আশঙ্কা কি আসলে আছে?
অসময়ের বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর সেখানে ব্যাপক হারে মাছ এবং তা খেয়ে হাঁস মারা যাচ্ছে। মাছ ও হাঁসের এ মড়কের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ কেউ কেউ ইউরেনিয়াম দূষণকে দায়ী করেছেন। তাদের ধারণা: সুনামগঞ্জ সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতের মেঘালয়ের ইউরেনিয়াম খনি থেকে সংলগ্ন নদীর পানি দূষিত হয়ে তা ভাটি অঞ্চলের হাওরের পানির সঙ্গে মিশে থাকতে পারে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে জানিয়েছে, ইউরেনিয়াম দূষণের কোন প্রমাণ মেলেনি। হাওরের দুর্গত অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পরীক্ষা করে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা রয়েছে।
হাওরের পানিতে ইউরেনিয়াম দূষণের আশঙ্কা কতটা? ইউরেনিয়াম থেকে কীভাবে দূষণ ঘটতে পারে? দূষণের প্রাথমিক লক্ষণ কী? এর ফলে পরিবেশগত কী কী ঝুঁকি রয়েছে? মাছ ও হাঁসের এ ধরনের ব্যাপক মড়ক লাগার কারণ আসলে কী?
এসব বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইন কথা বলেছে নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম এর সঙ্গে।
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থার্মাল হাইড্রোলিক সেফটি বিষয়ে ডক্টরেট করা এ নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ বলেন: পানির দুর্গন্ধ এবং হাঁস ও মাছের মড়কের ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণে আমার মনে হয়েছে, ইউরেনিয়াম দূষণের ফলে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার ফলে এমনটি ঘটতো তাহলে যেকোন পরীক্ষায়ই তা ধরা পড়ার কথা, কারণ ইউরেনিয়াম দূষণ ঘটলে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়, লাখ লাখ বছর এর রেশ থেকে যায়।
‘তাই যেকোন পরীক্ষায় কোন না কোন মাত্রায় ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যেত। আর তেজস্ক্রিয়তার ফলে এভাবে মাছ মারা যাবে সেটা বিশ্বাস করা আমার জন্য দুরুহ। কারণ তেজস্ক্রিয়তা ঘটলে তার ফলাফল আরও মারাত্মক হওয়ার কথা।’
তিনি বলেন, অভিযোগ যেহেতু উঠেছে তাই এ ব্যাপারে খুব সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমি মনে করি এ ব্যাপারে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হওয়া উচিত। তারপর বিভিন্ন ডাটা সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা উচিত।
মেঘালয়ের খনি থেকে ইউরেনিয়াম দূষিত পানি আসার সম্ভাবনা কতটা?
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি। খনির পাশেই রয়েছে রানীকর নদী। অনেকের আশঙ্কা ইউরেনিয়ামের বিষক্রিয়া রানিকর নদী হয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে প্রবেশ করে থাকতে পারে। যেহেতু নদীটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সুনামগঞ্জ রানীকরের ভাটিতে অবস্থিত।
ড. শফিকুল ইসলাম বলেন: ইউরেনিয়াম দূষণের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়। যেহেতু ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় মৌল যার বৈশিষ্ট হচ্ছে বারবার বিক্রিয়া করে বিভিন্ন উপজাত পদার্থ ও গ্যাস তৈরি করা তাই শুধু যে তা উত্তোলন করলেই দূষণ হবে তা নয়; এর উপস্থিতি থাকলেই তা পানিসহ বিভিন্ন জিনিসের সংস্পর্শে এসে বিক্রিয়া ঘটিয়ে নানা ধরনের পদার্থ তৈরি করতে পারে। সঙ্গে সীসা, বিসমাথ, রেডিয়াম, কোলোনিয়ামসহ বিভিন্ন পদার্থ এবং গ্যাস তৈরি করে যা খুবই বিষাক্ত। এই পদার্থগুলোর ছোট ছোট টুকরাগুলো পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করে। আর বিষাক্ত গ্যাস মিশে যায় বাতাসের সঙ্গে। এই দূষিত পানি অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে পারে, কারণ পানি যতদূর যায় তা বহন করে নিয়ে। সেক্ষেত্রে মেঘালয়ের খনি থেকে বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম দূষিত পানি প্রবেশের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা বলা যাবে না। তবে তা আসলেই প্রবেশ করেছে কিনা সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না।
মাছ-হাঁস মরার কারণ কী?
সরকারি সংস্থাগুলোর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা ধান পঁচার কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমেছে এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে মাছ মরে যাচ্ছে।
এই দাবিকে নাকচ করে ড. শফিকুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: কাঁচা ধান পঁচে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হওয়ার ব্যাপারটি আমার কাছে গুজব মনে হচ্ছে। কারণ কাঁচা ধান অর্থাৎ সবুজ গাছ পঁচে অ্যামোনিয়া গ্যাস নয়, তৈরি হয় শর্করা। এই শর্করা থেকে তৈরি হয় গ্লুকোজ। এই গ্লুকোজ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মাছ শক্তি পায়। কিন্তু কাঁচা ধান পঁচে তা থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে এটি সম্পুর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
মাছ-হাঁস এবং অন্যান্য জলজ প্রাণি মরার জন্য প্রধানত দুটি বিষয়কে তিনি দায়ী করেন: সার এবং কীটনাশক।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বেশি পরিমাণ সার প্রয়োগ করলে সেখান থেকে অ্যামোনিয়া ফসফেট, অ্যামোনিয়া হাইড্রোক্সাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে। কীটনাশক থেকেও ইউরেনিয়াম ফসফেটসহ বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে। কারণ আর কিছুদিন পরই ধান পাকার কথা ছিল। তাই এসময় কৃষকরা সাধারণত তাদের ক্ষেতে বেশি বেশি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে। এই সার ও কীটনাশকের বিষাক্ত গ্যাস পানির সঙ্গে মিশে তা মাছ-হাঁসসহ জলজ প্রাণি মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
নাশকতা?
এর পেছনে নাশকতা থাকার শঙ্কাও প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, নাশকতাও থাকতে পারে।
‘সে আশঙ্কাকে আমি একেবারেই উড়িয়ে দিতে চাই না। কারণ একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় বিষক্রিয়া ছড়িয়ে দিতে খুব বেশি বিষের প্রয়োজন হয় না।’
মেঘালয় রাজ্যের ইউরেনিয়াম বিতর্ক
মেঘালয়ের স্থানীয় সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে মেঘালয়ের স্থানীয় খাসি জনগোষ্ঠী ওই এলাকার রানিকর নদীর পানির রঙ নীল থেকে বদলে সবুজ হয়ে যেতে দেখেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (কেএসইউ) একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। সংগঠনটি নদীর মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করে। এমনকি জলজ প্রাণিহীন নদীটি এখন মৃতপ্রায় বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
খাসি নেতা মারকনি থঙনি সাংবাদিকদের বলেন: আমাদের সন্দেহ ইউরেনিয়াম খনি খননের ফলে এর থেকে নিঃসৃত ইউরেনিয়াম পানিতে মিশে নদীর পানির রঙ বদলে গেছে এবং নদীর মাছ মরে গেছে।
তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠির এ দাবিকে নাকচ করে মেঘালয় রাজ্য সরকার বলছে, তাদের দেশে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ইউরেনিয়াম খনির কোনো সম্পর্ক নেই।
রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিন্দো এম লানোঙ বলেন, ‘যদি তাই হতো তাহলে অন্যান্য জলজ প্রাণিগুলোও মারা যেত।’