২০১৬ সালে বাংলাদেশে ঘটে নারকীয় এক জঙ্গি হামলা। রাজধানী ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ওই হামলায় তিন বাংলাদেশি, এক ভারতীয়, নয় ইতালীয় এবং সাত জাপানি নাগরিক নিহত হন।
জাপানি নাগরিকদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশি, ভারতীয় এবং ইতালীয় নাগরিকদের আংশিক পরিচয় জানা গেছে।
নিহত তিন বাংলাদেশি নাগরিক:
গুলশানের ওই জঙ্গি হামলায় অবন্তি কবির (১৮) নামের এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণ নিহত হন। তিনি জর্জিয়ার ইমোরি অক্সফোর্ড কলেজের ছাত্র। ২০১৯ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার কথা ছিল তার। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে বেড়াতে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইফতারের পর বন্ধুদের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নিতে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পর সেখানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন অবন্তি কবির।
ওই হামলায় নিহত ফারাজ হোসেইন (২০)। তিনি ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি। ফারাজ অক্সফোর্ড কলেজ অফ ইমোরি ইউনিভার্সিটি থেকে ওই বছর স্নাতক অর্জন করেন। ২০১৬ সালের মে মাসের ১৮ তারিখে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ঢাকায় এসে দুই বন্ধুকে নিয়ে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে নৈশভোজে অংশ নেওয়ার পর জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন তিনি।
বাংলাদেশের শিল্প ব্যক্তিত্ব ইশরাত আকন্দও নিহত হয়েছে গুলশানের ওই হামলায়। পরিবারে তাকে লায়লা নামে ঢাকা হতো। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে শিল্পকলা চর্চা করে আসছেন। ইন্সটিটিউট অফ এশিয়ান ক্রিয়েটিভসের (আইএসি) তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের শিল্পকলা এবং চারুশিল্পীদের তিনি আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায় ২শ শিল্পীকে নিজেদের প্রতিভা প্রকাশে সহায়তা করেছেন। তিনি একটি কোম্পানিতে মানব সম্পদ পরিচালকও ছিলেন।
ইশরাত ইতালীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শুক্রবার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় রাত পৌনে নয়টায় ওই রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় নিহত হন তিনি। তিনি মুক্ত আকাশে পাখির উড়ার দৃশ্য খুব উপভোগ করতেন।
নিহত ভারতীয় নাগরিক:
হলি আর্টিজানের হামলায় তারুশি জেইন (১৮) নামের এক ভারতীয় নাগরিক নিহত হন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ছাত্রী ছিলেন। জঙ্গি হামলার শিকার হওয়ার এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। নিহত হওয়ার আগে তিনি ইস্টার্ন ব্যাংকে ইন্টার্নশীপ করতেন। তার বাবা সঞ্জিব জইন ঢাকায় ২০ বছর ধরে গার্মেন্টস ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
হামলায় নিহত হন নয় ইতালীয়ান নাগরিক:
ক্লাউদিয়া মারিয়া ডি এন্তোনা (৫৬)। তিনি ছিলেন ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই ইতালীয় টেক্সটাইল কোম্পানী বাংলাদেশে কাজ করছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ভারতে ও তারপরে বাংলাদেশে ছিলেন। ডি এন্তোনা এবং তার স্বামী ২০ বছরে ধরে বসবাস করেছি্লেন বাংলাদেশে। ওই হামলায় ইতালীয় নাগরিকদের মধ্যে একমাত্র মারিয়ার স্বামী গিয়ান গালিয়াজ্জো বোসছেত্তিই সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। তারা দুজন হলি আর্টিজানে নৈশভোজে অংশ নেন। পরে হামলায় মারিয়া নিহত হন এবং গিয়ান পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
সিমোনা মন্টি (৩৩) ছিলেন সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা। রোম থেকে কিছু দূরের মাগলিয়ানো সাবিনো শহরে বাস করতেন তিনি। জঙ্গি হামলার ঘটনার ওই সপ্তাহে ইতালিতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। তাই বন্ধুদের বিদায় জানানোর জন্য তিনি হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন। সেখানেই জঙ্গি হামলায় নিহত হন।
গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলায় মারকো তোন্দাত নামে আরো এক ইতালীয় নাগরিক নিহত হন। তার বয়স ছিল ৩৯ বছর। এক বছর আগে তিনি কাজেরন সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন। স্টুডিও টেক্স লিমিটেডে সুপারভাইজার পদে কর্মরত ছিলেন। ৪ জুলাই তার ইতালিতে ফিরে যাওয়ার কথার ছিল। ৫ বছর বয়সি এক মেয়ে সন্তান ছিল তার।
ইতালীয় নাগরিক নাদিয়া বেনেদেত্তি (৫২) বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্টুডিওটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন। ঢাকায় আসার আগে তিনি নেপাল থাকতেন। ওই প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর লন্ডনে অবস্থিত। এর ঢাকার শাখা অফিসেই ছিলেন নাদিয়া।
আদেলে পুগলিসি (৫০) ইতালির ক্যাটেনিয়ার নাগরিক। আদেলে আর্টসানায় একটি টেক্সটাইল গ্রুপের মাননিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি শনিবারে নিজে দেশে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই শুক্রবারের হামলায় নিহত হন তিনি।
ক্রিসটিয়ান রোজি (৪৭) ফেলেত্তো আমবারতো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিন বছরের জমজ কন্যা সন্তানের বাবা ছিলেন ক্রিসটিয়ান। তিনি বাংলাদেশে থেকে পণ্য নিয়ে ইতালিতে বিক্রি করতেন। ফিবরেস লিমিটেড নামে তার নিজের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং চীনে তার এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
ক্লাউডিও কাপেল্লি (৪৫) ভেদেনো ইতালির মোনজা প্রদেশের আল লামব্রো এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নিজের একটি টেক্সটাইল কোম্পানী চালাচ্ছিলেন। তার ৬ বছর বয়সী এক কণ্যা সন্তান ছিল।
ভিনসেনজো দাল্লেসত্রো (৪৬) ইতালির পিয়েদিমোনতে মাতেসের কাসেত্রার নাগরিক। তিনি ১৯৯৩ সালে গ্লোসোপের নাগরিক মারিয়াকে বিয়ে করেন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। টেক্সটাইলের কাজে তিনি ঢাকা এসেছিলেন।
মারিয়া রিবোলি (৩৪) স্বামী এবং তিন বছর বয়সী মেয়ে নিয়ে ইতালির সোলজায় বাস করতেন। তার তিন বছর বয়সের একটি কণ্যা সন্তান রয়েছে। তিনি ব্যবসায়িক কাজে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি একটি টেক্সটাইল কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। শুক্রবার রাতে গুলশান রেস্টুরেন্টে হামলায় নিহত হন মারিয়া।
নিহত হন জাপানী সাত নাগরিক:
গুলশান রেস্টুরেন্টে ওই হামলার ঘটনায় সাত জাপানি নিহত হন। এদের মধ্যে পাঁচ পুরুষ এবং দুই নারী। এরা হলেন, তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। এদের মধ্যে ওকামুরা মাকাতো(৩২)ছিলেন বিবাহিত। তার বাবার নাম কোমাকিচি ওকামোতো।
নিহতদের মধ্যে ছয়জনই মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তবে এদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।
এছাড়া জঙ্গি হামলায় অভিযানকালে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত:
গুলশানের জঙ্গি হামলায় অভিযানকালে নিহত হন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলা শহরের ব্যাংকপাড়ায়। ১১ ভাই বোনের মধ্যে ওসি সালাহউদ্দিন খান ছিলেন ষষ্ঠ। তিনি ১৯৯০ সালে যোগ দেন পুলিশ বাহিনীতে। চাকরি জীবনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করায় পেয়েছেন জাতিসংঘ শান্তি পুরস্কার। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী রোমকিম এবং এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার।
ওই হামলায় নিহত হয়েছিলেন আরেক পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম। তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর (উত্তরের) গোয়েন্দা পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার। তার বাড়ি ঢাকার কাছের জেলা মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার শান্ত কাটিগ্রামে। তিনি ছিলেন বিসিএস পুলিশের ৩০তম ব্যাচের সদস্য। মৃত্যুর পর তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে। এছাড়া তার ৮ বছর বয়সের এক ছেলে রয়েছে।