মহামারি করোনাভাইরাসে এই সম্মুখ যুদ্ধে ডাক্তার, চিকিৎসা কর্মী, পুলিশের পাশাপাশি সমান ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। ইতিমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করায় প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। তেমনি একজন সংবাদকর্মী শেখ সাবিহা আলম। কোভিড টেস্ট পজিটিভ হওয়ার পর অতি আদরের দুই কন্যা পিয়েতা আর সোমনীলের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে সাবিহাকে।
সাংবাদিক সাবিহাকে নিয়ে ‘সহযোদ্ধার নতুন যুদ্ধ-২’ শিরোনামে ফেসবুকে এক পোস্টে জাতীয় ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন লিখেছেন:
‘সাবিহা মেয়েটা আমার মাথায় পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। সহজে বলে ফেললাম ‘মেয়েটা’। দেখতেও ছোটখাটো হাল্কা-পাতলা গড়নের, কলেজ ছাত্রী বলে চালিয়ে দেয়া যায়। তাই বলে কাজের ক্ষেত্রে অত সহজ পাত্রী নয়। তুখোড় রিপোর্টার। শেখ সাবিহা আলম। অনেকদিন হেলথ বিটে কাজ করেছে। প্রথম আলোতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নয়ছয় নিয়ে তছনছ করা কঠিন রিপোর্ট করেছে। অনেক প্রফেশনাল। দৃঢ়চেতা।
আমি ওকে পেয়েছি অনেক সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসেবে। মা ক্যান্সারে মারা গেছেন, এটা একটা কারণ হতে পারে। সামাজিক দায়িত্ববোধও চোখ এড়ায় না। খুব ভদ্র। মিডিয়ার সহযোদ্ধাদের সাথে আমি ফর্মাল না কখনই। তারপরও ওর সম্মান ও ভদ্রতা চোখে পড়ার মত। আমাকে স্যারই ডাকবে। নাছোড়বান্দা।
আমাদের কার্যক্রমে সাবিহার অকুন্ঠ সমর্থন। পারতপক্ষে কোন প্রোগ্রাম মিস করে না, এসাইনমেন্ট থাকুক বা না থাকুক।
বলছিলাম সাবিহার কথা। কোন প্রোগ্রামে আসতে না পারলে, পরের সাক্ষাতে মাফ চাওয়ার ভঙ্গীতে একটা মিস্টি হাসি দেয়। আমিও হেসে ফেলি। একবার ওর জন্মদিনের শুভেচ্ছার উত্তরে ক্ষুদে বার্তায় লিখলো, আমি নাকি ওর কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহদাতাদের একজন। আমাকে সুহৃদ ভাবে বলে একটু বেশি বলেছে, বুঝলাম। কিন্তু আন্তরিকতার ছোঁয়াটাও টের পেলাম।
ওর হাসব্যান্ড আর্টিস্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা কাজে আমার কাছে এসেছিলো কয়েকদিন। পরে জননীর জন্য পদযাত্রার প্রথম পোস্টারটি ডিজাইন করে দিয়েছিলো স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। আকিফ রহমান মুন্না খুব মিশুক। দুজন মিলেছে ভালো।
সাবিহা একদিন আমাকে বলল, স্যার যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলবো। আপনি যদি শুধু লেখালেখি করেন, অনেক ভালো করবেন। আমি ধরে নিলাম, সুহৃদ-সুলভ অতিরঞ্জন। হাসছিলাম আমি। সাবিহা সিরিয়াস। ফেসবুকে আমার কয়েকটা লেখার উদাহরণ টেনে ওর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করার চেষ্টা করলো।
আমার সমস্যা হল, বলতে পারি অনেক কিছু কিন্তু লেখার ধৈর্য্য কম। ফেসবুক আসায় আবার স্ট্যাটাস লেখা শুরু হয়েছে নানা বিষয়ে। সচেতনতা কর্মসূচীর কাজে কিছু টুকরো লেখা লিখতে হয়েছে। অনেকেই বলেছে বই আকারে লিখতে। তেমন গা করি নি। সাবিহা এবার মাথায় পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে ভালো করেই। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে।
এই সাবিহা হঠাৎ করেই অচেনা এক পৃথিবীতে অচেনা সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। আমরা সবাই কমবেশি টের পাচ্ছি যার আঁচ। কিন্তু সাবিহার কষ্টটা আমরা শুধু ধারণা করতে পারি। পুরোপুরি অনুভব করা শুধু ভুক্তভোগীর পক্ষেই সম্ভব। কোভিড টেস্ট পজিটিভ হওয়ার পর অতি আদরের দুই কন্যা পিয়েতা আর সোমনীলের কাছ থেকে হৃদয়ভাঙ্গা দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। শিশু সোমনীল মায়ের জন্য গান গেয়েছে, কাল একাত্তর জার্নালে দেখলাম। সামনাসামনি এই দুই মেয়েকে দেখা হয়নি আমার। কিন্তু সাবিহার অসংখ্য লেখায় মেয়েদের নিয়ে ওর ভালোবাসাময় খুনসুটির দৃশ্যকল্প মনে গেঁথে আছে।
প্রিয় সাবিহা, একদিন তুমি আমাকে ফোন করলে। স্যার, আজ দুপুরে আমার বাসায় একটু আসতে পারবেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কারও কোন সমস্যা?
না স্যার। এমনি, একসাথে দুপুরে খাবো।
আমার দুর্ভাগ্য, সেদিন একটা প্রোগ্রাম ছিলো। প্রায় প্রতিদিন যেমন থাকে।
আমি বললাম, তোমার রান্না খেতে দেখো একদিন হুট করে চলে আসবো।
সাহস হারিওনা সাবিহা। আমি জানি তুমি পারবে এই যুদ্ধকেও জয় করতে। আমরা সবাই তোমার জন্য আল্লাহতা’আলার কাছে দোয়া করছি।
আর হ্যাঁ, এই অবসরে ইউটিউব থেকে আরও কিছু দেশি খাবারের রেসিপি রপ্ত করে নাও। এই আঁধার কেটে গেলে তোমার হাতের রান্না খেতে একটুও দেরী করবো না।’